বিশ্বসৃষ্টি ও মানুষের আদি উৎস-সংক্রান্ত বাইবেলের আদিপুস্তকের উদ্ধৃত বক্তব্যসমূহের একাধিক পর্যায়ে গরমিল সচেতন কোন পাঠকের নজর এড়াবার কথা নয়। বিশেষত, মানুষের সেই মানুষ পুরুষ হোক বা নারী হোক–আদি উৎস-সম্পর্কিত বিষয়ের সামঞ্জস্যহীনতা খুবই প্রকট। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীতে বিভিন্ন জীব-জানোয়ারের আবির্ভাবের তুলনায় মানুষের আবির্ভাবের সময়কালের গরমিলও অস্বাভাবিক নয়। তদুপরি, মানুষের সৃষ্টি সম্পর্কে বাইবেলে যে ধারণা দেয়া হয়েছে, যেকোন তাৎপর্যেই তার অর্থ খুঁজে বের করা মুশকিল। বিশেষ করে বাইবেলের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদসমূহের প্রেক্ষপটে এই অর্থ নির্ণয় সত্যি দুরূহ। তবে, যদি বাইবেলের এসব বক্তব্য সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় আনা যায়, তবে সে-সবের একটা অর্থ যে দাঁড়ায় না, তা নয়। এই কারণেই এখানে এই পর্যালোচনায় বাইবেলের উভয় পাঠ বা রচনার উদ্ধৃতি তুলে ধরা হল? এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুপ্রতিষ্ঠিত তথ্যাবলীর নিরিখে আলাদা আলাদাভাবে বাইবেলের ওইসব বক্তব্যের তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হল :
জেহোভিস্ট পাঠ : পর্যালোচনা
বাইবেল আদিপুস্তকের জেহোভিস্ট রচনায় শুধু একবারই পৃথিবী ও আকাশমণ্ডল সৃষ্টির বিষয়টা উল্লিখিত হয়েছে। পক্ষান্তরে, সেখানে প্রাধান্য দিয়ে আলোচিত হয়েছে মানুষ-সৃষ্টির বিষয়টি। কিন্তু কথা সেটি নয়। কথা হচ্ছে, বাইবেলের এই জেহোভিস্ট রচনায় বিশ্বসৃষ্টির কাহিনী যেভাবে শুরু করা হয়েছে, তা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত সত্যের সঙ্গে আদৌ। অসঙ্গতিপূর্ণ। যেমন, আদিপুস্তকের এই জেহোভিস্ট পাঠে বলা হয়েছে যে, মানুষ যখন সৃষ্টি হয়েছিল তখন পৃথিবীতে গাছপালার কোন অস্তিত্ব ছিল না এবং তখনও সদাপ্রভু ঈশ্বর পৃথিবীতে বৃষ্টি বর্ষাণনি, আর ভূমিতে কৃষিকর্ম করিতে মনুষ্য ছিল না।”
এই বর্ণনায় আরও দেখা যাচ্ছে, বিধাতা “ধূলির মানুষকে” মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি করেছেন। এ বক্তব্যের দ্বারা পৃথিবীর মাটি থেকে মানব-সৃষ্টির উপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং এই প্রতীকী বর্ণনার দ্বারা মাটিকে মানব-সৃষ্টির উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অথচ, উপরের এতদালোচনায় অপেক্ষাকৃত আধুনিক রচনা সেকেরভোটাল পাঠে মানুষের সৃষ্টিতে মৃত্তিকার কোন উল্লেখ পর্যন্ত নেই।
জীবজগতের আদি উৎস সম্পর্কে ‘রিভাইজড স্ট্যান্ডার্ড ভার্সন অব বাইবেলের (১৯৫২) জেহোভিস্ট রচনায় বলা হয়েছে।
“সদাপ্রভু ঈশ্বর সকল বন্য পশু ও আকাশের সকল পক্ষী সৃষ্টি করিলেন।” (বাণী ১৯)
এখানে কিন্তু এই সকল বন্য পশু ও পাখির আদি উৎস সম্পর্কে তেমন কিছুই বলা হয়নি। পক্ষান্তরে, ফরাসী ভাষার বাইবেলের (ইকুমেনিক্যাল ট্রান্সলেশন অব দি বাইবেল) একই বাণীতে বলা হয়েছে। এভাবে সদাপ্রভু ঈশ্বর পুনরায় মৃত্তিকা হইতে বন্য পশুসকল ও আকাশের পক্ষীসকল সৃষ্টি করিলেন। (বাংলা বাইবেলের ১৯৭৩ সংস্করণের বক্তব্যও অনেকটা ফরাসী বাইবেলের অনুরূপ) অর্থাৎ ফরাসী (এবং বাংলা) বাইবেল থেকে দেখা যাচ্ছে, সকল জীবন্ত যেমন প্রাণী মানুষ পশু-পাখি ইত্যাদি সৃষ্টি হয়েছিল মাটি থেকে। অন্যদিকে ইংরেজি, ফরাসী (কিংবা বাংলা) বাইবেলে মানুষ সৃষ্টির কতকাল আগে অথবা কতকাল পরে জন্তু-জানোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। বাইবেলের উভয় পাঠে অবশ্য দেখা যায়, “তাহাদের কি কি নাম রাখিবেন তাহা দেখার জন্য (স্রষ্টা) সেই সকলকে তাহার (আদমের) নিকট আনিলেন]” এরদ্বারা অবশ্য বলা হচ্ছে না যে, জন্তু-জানোয়ার মানুষের আগে-না-পরে সৃষ্টি হয়েছিল। জেহোভিস্ট পাঠের শেষপর্যায়ে নারীকে পুরুষের দেহাংশ থেকে সৃষ্টি করার কথা বলা হয়েছে। সেকেরডোটাল পাঠে অবশ্য এ সম্পর্কে বিস্তারিত কোন বিবরণ নেই।
বলা অনাবশ্যক যে, জেহোভিস্ট পাঠ এ ধরনের প্রতীকীর ব্যবহারের জন্য বৈশিষ্ট্যের দাবিদার। যেমন, মানুষ যে মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি সেই বিষয়টার উপরে এর লেখকদের সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে দেখা যাচ্ছে। এই ধরনের প্রতীকী বক্তব্যের শব্দচয়নেও বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। যেমন, প্রথম মানুষের নাম হচ্ছে, আদম। এই ‘আদম’ শব্দটি হিব্রু ভাষায় কালেকটিভ নাউন বা সমষ্টিবাচক বিশেষ্য (আকারে একবচন কিন্তু অর্থে বহুবচন)। এই ‘আদম’ শব্দটি এসেছে ‘আদামা’ শব্দ থেকে, যার অর্থ “মৃত্তিকা”।… … … …
এ কথা স্বীকার্য যে, মানুষ তার অস্তিত্বের জন্য মৃত্তিকার উপরে নির্ভরশীল। এভাবে আরো একটি প্রতীকী শব্দ এই জেহোভিস্ট পাঠে বিদ্যমান। শব্দটি হচ্ছে, ‘প্রত্যাগমন’। ‘মানুষের পতনের’ অধ্যায়ে (আদিপুস্তক, ৩১, ১৯-২০ আদম সন্তান ও সমস্ত জীবন্তবস্তুর ভাগ্যলিপি অভিন্ন বলে বাইবেল-লেখক উল্লেখ করেছেন। বলেছেনঃ “সকলে একস্থানে যাইবে, সকলে ধূলি হইতে এবং সকলে ধূলিতে মিশিয়া যাইবে।” (বাংলা বাইবেলে আছে : “তুমি তো তাহা হইতেই গৃহীত হইয়াছ; কেননা তুমি ধূলি, এবং ধূলিভেদ প্রতিগমন করিবে।” এখানে বহুবচন অনুপস্থিত।
মৃত্তিকায় মানুষের এই প্রত্যাগমনের বিষয়টি গীত-সংহিতায় (১০৪, বাণী ২৯) পুনরুলিখিত হয়েছে; এবং বুক অব জব বা ইয়োব পুস্তকেও (৩৪, ১৫) এই ধারণার উল্লেখ দেখা যায়।