অন্যদিকে, গাথা বা মহাকাব্যের মত যত রঙই ছড়ানো হোক, বর্ণিত কাহিনীর মধ্যেও একটি সত্য ঘটনা যে লুকানো রয়েছে, তা স্বীকার করতে হয়।
অনুরূপভাবে, মথি তার সুসমাচারে যতই আদি-ভৌতিক কাহিনীর অবতারণা করুন, সুসমাচারগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বৈপরিত্য যতই মারাত্মক হয়ে ধরা পড়ক, আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সত্যের তুলনায় সেসব রচনার বর্ণনা যতই অবাস্তব ও অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হোক এবং পরবর্তী পর্যায়ে এসব কাহিনীকে যতই ঝুটলানো হয়ে থাক-না-কেন ওইসব সুসমাচারের রচনার মধ্যেও সেই একই ধরনের সত্য ঘটনা লুকানো রয়েছে।
বলা অনাবশ্যক, সুসমাচার রচনার ক্ষেত্রে এই ধরনের সত্য ঘটনাকে ভিত্তি ধরে নিয়েই তার সাথে মেশানো হয়েছে মানবীয় কল্পনার নানারূপ, নানারঙ, নানাবর্ণ, নানাগন্ধ ইত্যাদি। কল্পনার এতসব রূপ ও রঙ সত্ত্বেও কিন্তু যীশুখ্রিস্টের মিশন তথা তার কার্যকলাপ ও বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তবে, প্রচলিত বাইবেল তথা ইঞ্জিলে যীশুর সেই মিশনকে যেভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে, শুধু সেই বর্ণনার ক্ষেত্রেই দেখা দেয় যত সন্দেহ ও সংশয়।
এখানে এই গ্রন্থকার সেই সংশয় ও সন্দেহের উদ্রেক হওয়ার মতো কিছু কারণ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস ইতোমধ্যে চালিয়েছেন। অনেকেই সম্ভবত মত প্রকাশ করবেন, ড. মরিস বুকাইলি রচিত ‘বাইবেল কোরআন বিজ্ঞান’ রচিত গ্রন্থে যেহেতু এ-সকল বক্তব্য তথা মন্তব্য তিনি তুলে ধরেননি, এখানে কেন তা আসবে? এই গ্রন্থকার বিনয়ের সাথে সে-সকল পাঠকদের উদ্দেশে বলছেন :
‘আমি মূলত ড. মরিস বুকাইলি রচিত ‘বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান’ গ্রন্থকে অবলম্বন করে পরোক্ষ এবং কখনো কখনো প্রত্যক্ষভাবে তাঁর গ্রন্থটিকে পাঠকদের নিকট বর্ণনা করতে চাচ্ছি, আর তাই তার অর্থাৎ ড. মরিস বুকাইলি রচিত গ্রন্থে উল্লিখিত মন্তব্য, বক্তব্য ও উক্তিকে আরও দৃষ্টান্ত-সমৃদ্ধকরণে প্রয়াসী এবং এ কারণেই গ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে প্রসঙ্গ : ‘ড. মরিস বুকাইলির বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান শুধু বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান’ নয়। তবে, আমি সম্মানিত সে-সকল বোদ্ধা পাঠকগণকে এই বলে আশ্বস্ত করছি, ড. মরিস বুকাইলি রচিত বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান অবলম্বিত আমার এই গ্রন্থে তাঁর অর্থাৎ ড. মরিস বুকাইলি রচিত ‘বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান’ গ্রন্থে পরিবেশিত সকল তথ্য ভিন্নরূপ উপস্থাপনায় পরিবেশিত হয়েছে। সেই সঙ্গে তাঁর গ্রন্থের বিভিন্ন বিষয়কে ভিন্নআঙ্গিকে উপস্থাপন করে সহজে পাঠকমনে বোধগম্য করার প্রয়াস রয়েছে, যেমনি কিছুটা বেশি তথ্য পরিবেশনের দায় গ্রহণ করা হয়েছে।
মূলত, এ বইটি গ্রন্থিত হয়ে প্রকাশিত হলো ড. মরিস বুকাইলি রচিত, ‘বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান’ গ্রন্থটি প্রকাশ হয়েছে বলেই, কিন্তু তথ্য-জ্ঞানের এই প্রতিযোগিতার যুগে অবিরত নতুন নতুন তথ্য আমাদের হাতে আসছে, আর তাই এই গ্রন্থে কিছুটা প্রাসঙ্গিকতার কারণে বেশি তথ্য পরিবেশিত হয়েছে এবং মূল বইয়ের বক্তব্যকে পরোক্ষভাবে অবিকৃত রেখে, যে-কারণে ঔদ্ধত্যপনা হয়ে গেলেও এই গ্রন্থকার বোন্ধাপাঠকদের উদ্দেশে বলতে বাধ্য হচ্ছেন এই গ্রন্থে মূলগ্রন্থের চেয়ে বেশি তথ্য সন্নিবেশিত হওয়ায় অন্যান্য গ্রন্থকারের গ্রন্থ থেকেও তথ্য নেয়া হয়েছে। এই গ্রন্থপাঠে পাঠকবর্গ উপকৃত হবেন বৈ অপকৃত হবেন না, এখন পাঠকদের বক্তব্য-সমালোচনা শোনা ও জানার দায় নিয়ে ক্ষমাসুন্দরদৃষ্টি কামনা করে এবং এই গ্রন্থ প্রকাশে যে-সকল গ্রন্থকারের গ্রন্থ থেকে তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে সম্মানিত সে সকল গ্রন্থকার, প্রকাশক ও সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কয়েকটি উদাহরণ পেশ করছিঃ
সুসমাচার লেখক ‘লূক’-এর বিভ্রান্তি
সুসমাচার লেখক লুক তার সুসমাচারে যীশুখ্রিস্টের জন্মকাল সম্পর্কে লিখেছেন,
“তখনকার অগস্ত কৈর (Augustus Caesar)-এর এক রাজা বের হলো যে, সাম্রাজ্যের সমুদয় লোককে নাম লেখাতে হবে। সুরিয়ার (Syria) দেশাধ্যক্ষ (Governor) কুরীশীয়ের সময় এই প্রথম নাম লেখানো হয়। সবাই নাম লিখে দেয়ার জন্য নিজ নিজ নগরে গিয়েছিল। আর যোসেফও গালীলের নাসরত নগর থেকে যিহুদিয়ার বেথেলহেম আখ্যাত দায়দের নগরে গেলেন, কারণ, তিনি দায়দের কুর ও বংশজাত ছিলেন; তিনি তাঁর বাগদত্তা স্ত্রী মরিয়মের সাথে নাম লিখে দিতে গেলেন। মরিয়ম তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন; তারা যখন সেখানে ছিলেন, তখন তার সন্তান প্রসবের সময় উপস্থিত হলো, আর তিনি তার প্রধমজাত পুত্রকে প্রসব করলেন …” (২ : ১-৭)।
অর্থাৎ, লুকের এই বর্ণনা থেকে জানা যাচ্ছে যে, সিরিয়ার গভর্নর কুরীশীয়ের সময় রোম সাম্রাজ্যে প্রথম লোক গণনা করা হয় এবং এই লোক গণনায় নাম লিখে দিতে আসন্ন সন্তানপ্রসবা মরিয়ম তার বাগদত্তা স্বামী যোসেফের সাথে গালীলের নাসরত নগর থেকে ৭০ মাইল দূরবর্তী বেথেলহেম নগরে গিয়েছিলেন এবং তখনই তিনি তাঁর প্রথমজাত সন্তান যীশুকে প্রসব করেন। কিন্তু লুক বর্ণিত এই ঘটনা ইতিহাস দ্বারা সমর্থিত নয়। কারণ, যীশুর জন্মকালে রোম সাম্রাজ্যে লোক গণনার এবং সিরিয়া দেশে কুরীশীয় নামে দেশাধ্যক্ষ থাকার প্রমাণ খ্রিস্টান পণ্ডিতদের কাছে নেই। বরং, ইহুদী ইতিহাসবিদদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ফ্লেবিয়াস যোসেফাসের লেখা অনুযায়ী যীশুর জন্মের সাতবছর পরে রোম সাম্রাজ্যে প্রথম লোক গণনা করা হয় এবং যীশুর জন্মের দশবছর আগে থেকে হেরোদের মৃত্যুকাল পর্যন্ত সিরিয়ায় যথাক্রমে স্টিপলাস ওয়ারদাছ (Stiplus Wardus), সেনটিরিস (Sentiris) এবং তীথনিস (Titnis) দেশাধ্যক্ষ ছিলেন বলে Ency. Bitanica, Under “Chronicle”-এ নিশ্চিত করা হয়েছে।