অন্যদিকে, তিনি বলেন,
“এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বাইবেলের সুসমাচার-পুস্তকের সূচনাপর্বের পর্যালোচনায় আমাকে কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। প্রথম পৃষ্ঠাতেই রয়েছে যীশুর বংশলতিকা কিন্তু এ বিষয়ে মথি-লিখিত সুসমাচারের বক্তব্য স্পষ্টভাবে লুক-রচিত সুসমাচারের বক্তব্যের বিপরীত। শুধু তাই নয়, বাইবেলের এই নতুন নিয়মে অর্থাৎ প্রচলিত ইঞ্জিলের ক্ষেত্রে পরবর্তী সমস্যা দেখা দেয়, পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের কাল নিয়ে। এ বিষয়ে লুক-লিখিত সুসমাচারের যে তথ্য, তা আধুনিক তথ্য-জ্ঞানের সাথে সম্পূর্ণ অসঙ্গতিপূর্ণ।
অবশ্য, বাইবেলের বক্তব্যের মধ্যে এই যে পারস্পরিক বৈপরীত্য, এই যে অবাস্তবতা ও অসঙ্গতি, তা কিন্তু স্রষ্টার উপর আমার বিশ্বাসকে কখনো চিড় ধরাতে পারেনি। বরং, আমার মনে হয়েছে বাইবেলের এই অসঙ্গতির জন্য মানুষই দায়ী। প্রকৃতপক্ষে, আর কারোপক্ষেই বলার উপায় নেই, বাইবেলের বাণীর প্রাথমিক বা আদিরূপ কি ছিল! কে জানে, সুদূর অতীতে কে কিভাবে বাইবেল সম্পাদনা করে গেছেন। আর কতোজন যে ইচ্ছাকৃতভাবে এর উপর কলম চালিয়ে গেছেন, কে তা বলতে পারে? এভাবে কতোজন যে নিজ ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় বাইবেলকে তার বর্তমান আকার দিয়ে গেছেন, তার খোঁজ কে দেবে? কিন্তু তাঁরা যারাই হোন, তারা কি কোনোদিন ভেবেছিলেন যে, এমন একদিন আসবে, যেদিন বিজ্ঞানের সুপ্রতিষ্ঠিত সত্যের নিরিখে বাইবেলের ওইসব বৈপরীত্য ও অসঙ্গতি প্রকট হয়ে ধরা পড়বে?
মূলত, বাইবেলের এই ধরনের রদবদল সাধন করে সেকালে ওইসব ব্যক্তি ভালো কাজ করেছেন বলে যতোই মনে করে থাকুন-না-কেন, বিশেষজ্ঞ ও গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তারা ছিলেন একদম অনবহিত। অথবা, নিজেদের এসব কাজের ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতি দৃষ্টি পড়লেও তারা সম্ভবত দক্ষতার সাথে সবার চোখে ধুলো দিয়ে পার পেতে চেয়েছিলেন। বাইবেলের মথি ও যোহন-লিখিত সুসমাচারের আলোচনায় প্রমাণ তুলে ধরে দেখানোর চেষ্টা করা হবে যে, খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞ ও আঁদরেল ভাষ্যকারেরা পর্যন্ত এসব ত্রুটি-বিচ্যুতির ব্যাপারে কিভাবে শব্দের মারপ্যাঁচে আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রয়াস পেয়ে গেছেন।
পক্ষান্তরে, বাইবেলের কোনো বক্তব্যের অবাস্তবতা কিংবা স্ববিরোধিতা ধামাচাপা দিতে কেউ কেউ অতি বিস্ময়করভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়কে আরো বেশি দুর্বোধ্য করে তুলেছেন। এভাবে তারা কখনো-সখনো বাইবেলের এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি ধামাচাপা দেয়ার কাজে ব্যর্থও হননি। বাইবেলের পুরাতন নিয়মের এতোসব মারাত্মক ত্রুটি-বিচ্যুতির ব্যাপারে এতো বিপুলসংখ্যক খ্রিস্টান কেন যে এরকম অনবহিত কিংবা কেন যে এত নীরব, তার ব্যাখ্যা ও কারণ বোধ করি, পূর্বোক্ত বিষয় বৈ অন্য কিছু নয়।
এ গ্রন্থে প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত ধর্মগ্রন্থের মর্ম উপলব্ধির ব্যাপারে বিজ্ঞানের ব্যতিক্রমধর্মী প্রয়োগ ও অবদানের বিশদ উদাহরণ রয়েছে। সেখানে দেখা যাবে, কোরআনে এমন কিছুসংখ্যক বাণী রয়েছে যেসব বাণীর অর্থ এতকাল ধারণা-শক্তির অতীত না হলেও সর্বসাধারণের কাছে অনেকটা দুর্বোধ্য হয়েই বিরাজ করছিল।
কিন্তু এখন সেইসব দুর্বোধ্য বাণী আধুনিক সেকুলার-জ্ঞানের আলোকে ক্রমশ অধিকতর স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই অবস্থায় ইসলাম সম্পর্কে যখন বলা হয়, এই ধর্ম সবসময়ই বিজ্ঞানকে তার যমজ বোন হিসেবে বিবেচনা করে থাকে, তখন বিস্ময়ের কি থাকতে পারে? আবির্ভাব পর্বের সূচনা থেকেই ইসলাম তার অনুসারীদের প্রতি বিজ্ঞানচর্চার নির্দেশ দিয়ে আসছে। এই নির্দেশ পালনের ফলে ইসলামী সভ্যতার সেই মহান যুগে মুসলমানেরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উৎকর্ষ সাধন হয়েছিল এবং তা থেকে রেনেসাঁর পূর্বপর্যন্ত পাশ্চাত্য জগৎ হয়েছিল বিশেষ লাভবান। এখন ধর্মগ্রন্থ ও বিজ্ঞানের সংঘাত জোরদার হওয়ার কারণে আধুনিক বিজ্ঞানের সন্ধানী-আলোকে নতুন করে কোরআনের বিভিন্ন বক্তব্যর উপরে দৃষ্টি নিপতিত হচ্ছে। আর এ কারণেই গড়ে উঠছে কোরআন ও বিজ্ঞানের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের একটা সমঝোতা।
ইতিপূর্বে কোনো কোনো বিষয়ে সম্যক-জ্ঞানের অভাব থাকায়, কোরআনের বিভিন্ন বক্তব্যকে অস্পষ্ট বা দুর্বোধ্য বলে আখ্যায়িত করা হত। বর্তমানে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান কোরআনের ঐসব বক্তব্যের ব্যাখ্যায় প্রভূত সহায়তা জুগিয়ে যাচ্ছে।”
০২. মধ্যযুগীয় কাব্য-কাহিনী বনাম সুসমাচার কাহিনী
প্রকৃতপক্ষে, মধ্যযুগীয় সাহিত্যের বিভিন্ন গাথা বা কাব্য-কাহিনী যেভাবে গড়ে উঠেছিল, সুসমাচার-রচনার কাহিনী অনায়াসেই সেসবের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এরমধ্যে সর্বাধিকভাবে তুলনীয় হতে পারে ‘সঙ অভ রোল্যান্ড’ নামক সর্বজনপরিচিত কাহিনী-কাব্যটি। এই কাহিনী-কাব্যে একটি সত্য ঘটনাকে রূপকথার মত সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, ঘটনাটি ছিল এইরূপ :
শার্লিমেনের সেনাবাহিনীর একটি অংশের দলপতি ছিলেন রোল্যান্ড। তিনি যখন তাঁর বাহিনীকে নিয়ে ফিরে আসছিলেন, তখন রনসভকস এর নিকট তাদের উপর হামলা চলে। ইতিহাসে দেখা যায়, ঘটনাটি ঘটেছিল ৭৭৮ সালের ১৫ই আগস্ট। (এগিনহার্ড) মূলতঃ এ ঘটনাটি সাংঘাতিক এক যুদ্ধের কাহিনী হিসেবে প্রচার লাভ করে। শুধু তাই নয়, শেষপর্যন্ত এই যুদ্ধের ঘটনাটি ধর্মযুদ্ধের কাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। উল্লেখ্য যে, শার্লিমেনকে তার সীমান্তরক্ষার জন্য প্রায়ই প্রতিবেশি শক্তির অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হতে হত। অথচ, রূপকথার রচয়িতাবৃন্দ এই কাহিনীকে কেন্দ্র করে তাদের কল্পনাশক্তির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ছেড়েছেন।