এখন যে কোরআন, এই হলো সেই গ্রন্থ। অপরপক্ষে, খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতিতে সংকলিত হয়েছে। তাদের ধর্মগ্রন্থের বাণীসমূহ সরাসরি প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত নয়; বরং তা বহুজনের বর্ণিত পরোক্ষ বিবরণী।
মূলত, যীশুর জীবন-বৃত্তান্ত কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর চাক্ষুষ বিবরণী থেকে পাওয়া যায় না। যদিও অনেক খ্রিস্টানই মনে করেন, বাইবেলে বর্ণিত ঘটনাবলী প্রত্যক্ষদশীর বিবরণ। খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামের ধর্মগ্রন্থের বাণীর সঠিকত্ব ও নির্ভুলতা নিয়ে যেসব প্রশ্ন ওঠে, এই তার মূল পটভূমি।
যে দ্বন্দ্ব আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যাবলীর সাথে প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত বলে কথিত ধর্মগ্রন্থসমূহের, তা সবসময় মানুষের চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে। প্রথমে মনে করা হত, বিজ্ঞানের আবিস্কৃত সত্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়াটাই বুঝি কোনো ধর্মগ্রন্থের বাণীর সঠিকত্ব ও নির্ভুলত্বের প্রয়োজনীয় প্রমাণ। সেন্ট অগাস্টাইন তার ৮২নং পত্রে ধর্মগ্রন্থের সঠিকত্ব-বিচারের এই নিয়ম প্রবর্তন করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের আরো অগ্রগতি সাধিত হলে দেখা যায়, বিজ্ঞানের সাথে বাইবেলোক্ত সুসমাচারসমূহের অসঙ্গতি খুবই স্পষ্ট। পরিশেষে, এই মর্মে সিদ্ধান্ত হয় যে, অতঃপর বাইবেলের তুলনামূলক বিচার-পর্যালোচনার ধারা স্থগিত থাকবে। এই সিদ্ধান্তের ফলেই এখন এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, যেখানে এসে বাইবেলের ভাষ্যকার ও বিজ্ঞানীরা একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। যাহোক, যে গ্রন্থের বাণী সম্পূর্ণভাবে নির্ভুল নয়, তাকে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করে নেয়া যায় না।
এক্ষেত্রে যদিও সামঞ্জস্য বিধানের একটা পথ খোলা থাকে। তা হলো, ধর্মগ্রন্থের যেসব বক্তব্য বিজ্ঞানের আলোকে গ্রহণযোগ্য নয়, সেসব বক্তব্যকে অসত্য বলে বিবেচনা করে সান্ত্বনা লাভ করা। কিন্তু এ পন্থাও ধর্মীয় নিয়ম বলে গ্রহণ করা হয়নি।
পক্ষান্তরে, ধর্মগ্রন্থের অখণ্ডতা ও তার প্রতিটি বাণীর সত্যতার উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা এবং ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা বাইবেলের সুসমাচারসমূহের প্রতিটি বাণীকে সত্য বলে চালানোর জন্য কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। অথচ, কোনো বিজ্ঞানীর পক্ষেই এ ধরনের অযৌক্তিক কোনো বিষয়কে সমর্থন করা অসম্ভব।
বাইবেলের ক্ষেত্রে সেন্ট অগাস্টাইন যেভাবে মনে করতেন, সেভাবে ইসলামের অনুসারীরাও সবসময় মনে করে আসছেন যে, আসমানী কিতাবের বক্তব্য বৈজ্ঞানিক সত্যের সমর্থক। এমনকি, আধুনিককালে ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কোরআন সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনার পরেও এ মনোভাব পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন দেখা যাচ্ছে না। এই গ্রন্থপাঠে দেখা যাবে, বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের বহু বিষয় কোরআনে উল্লিখিত রয়েছে এবং কোরআনের বাণীসমূহ বাইবেলের বাণীর তুলনায় নির্ভুল। বাইবেলে বিজ্ঞান-সংক্রান্ত বক্তব্য অল্প কিছুসংখ্যক; কিন্তু সেগুলো বৈজ্ঞানিক সত্যের বিরোধী।
পক্ষান্তরে, বিজ্ঞান-সংক্রান্ত বক্তব্য কোরআনে প্রচুর এবং তার সবগুলোই সত্যনিষ্ঠ। বস্তুত, কোরআনে বিজ্ঞান-সংক্রান্ত একটি বক্তব্যও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেটি বৈজ্ঞানিক সত্যের বিরোধী। ড. মরিস বুকাইলির আলোচ্য গবেষণায় কোরআন সম্পর্কে এই মূল সত্যটি সুস্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে।
হাদীস হল, মোহাম্মদের (দঃ) বাণীর সংকলন। হাদীসের পুস্তকগুলোতে এমন কিছু কিছু বক্তব্য দেখা যায় যেগুলো বৈজ্ঞানিক দিকথেকে অগ্রহণযোগ্য।
উল্লেখ্য, ইসলামের সুনির্দিষ্ট নীতির আলোকেই হাদীসগ্রন্থসমূহের উপর এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। অজানা নয়, কোনো বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোরআনের সুস্পষ্ট নীতি ও নির্দেশঃ
বিজ্ঞান তথা যুক্তির নিরিখে কোনো বক্তব্য যদি অসঙ্গত বিবেচিত হয়, তবে সে বক্তব্যের সূত্র যতো সঠিকই হোক না কেন, তা বাতিল বলে গণ্য হবে।
ধর্মগ্রন্থের কোনো বক্তব্যকে বৈজ্ঞানিক সত্যের দিক থেকে গ্রহণযোগ্য কিংবা অগ্রহণযোগ্য বলে সাব্যস্ত করার আগে বৈজ্ঞানিক সত্য সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা প্রদান জরুরি।
এ বিষয়ে একটি কথার উপর ড. মরিস বুকাইলি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
তিনি বলেন,
“বৈজ্ঞানিক তথ্য-পরিসংখ্যান বলতে সেই সত্যকে বোঝাতে চেয়েছি, যা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। এই বিবেচনায় ব্যাখ্যামূলক সেইসব থিওরি বা সিদ্ধান্ত বাদ দেয়া হয়েছে যেসব থিওরি একসময় কোনো প্রাকৃতিক বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হত, কিন্তু বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে সেগুলোর উপযোগিতা হারিয়ে গেছে।“
এ কথার মাধ্যমে যা বলতে চাওয়া হচ্ছে, তা হলো, ড. বুকাইলি শুধু সেই বৈজ্ঞানিক সত্যকেই বিচারের মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করেছেন যা অখণ্ডনীয় এবং অবিসম্বাদিতভাবেই সত্য। আর যেসব বিষয়ে বিজ্ঞান এ যাবত কিছু আংশিক বা অসম্পূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছে, সেসব ক্ষেত্রে শুধু ততোটুকু গ্রহণ করা হয়েছে যতোটুকু বৈজ্ঞানিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং যতোটুকুর ব্যবহারে ভুলের কোনো আশঙ্কা নেই।
এখানে একটি উদাহরণ তুলে ধরে ড. মরিস বুকাইলি বলেন,
“যদিও পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের কোনো সন-তারিখ বিজ্ঞানীদের হাতে নেই, তবু সুদূর অতীতের মানুষের নানাকীর্তির ধ্বংসাবশেষ ও বিভিন্ন নিদর্শন আবিস্কৃত হয়েছে। এসব আবিষ্কার থেকে আমরা মোটামুটিভাবে মানুষের আবির্ভাবের একটা সময়কাল পাচ্ছি। আর সেই সময়টা হচ্ছে–খ্রিস্টপূর্ব এক কোটি বছর আগে (টেন্থ মিলিয়ন বি. সি.)। এ বিষয়ে বাইবেলে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাকে কিছুতেই বিজ্ঞানের সত্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে বিবেচনা করতে পারি না। বাইবেলের আদিপুস্তকে (টেক্সট অব জেনেসিস) আদি মানুষের আবির্ভাবের অর্থাৎ আদম সৃষ্টির সময় যে বংশ-তালিকা দেয়া হয়েছে, সে সময়টা হচ্ছে মোটামুটিভাবে খ্রিস্টপূর্ব সাইত্রিশ শতাব্দীর।। ভবিষ্যতে বিজ্ঞান হয়তো এ বিষয়ে আরো তথ্য আবিষ্কার ও সরবরাহ করতে সক্ষম হবে এবং তার মাধ্যমে আমরা অনায়াসেই মানুষের আবির্ভাবের প্রশ্নে এ পর্যন্ত আবিস্কৃত সময়কালের তুলনায় অনেক সঠিক সময় তথা তারিখ পেয়ে যাব। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে, ভবিষ্যতের সেই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হবে আধুনিক বিজ্ঞানের ইস্পাতকঠিন সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত।”