পাশ্চাত্য জগতে বাইবেলের সমালোচনামূলক গবেষণা একদম হালের ঘটনা। শত শত বছর ধরে সেখানকার মানুষ নতুন ও পুরাতন নিয়ম তথা বাইবেলকে যখন যে অবস্থায় পেয়েছে, তখন সে অবস্থায় তা গ্রহণ করে পরিতৃপ্ত থেকেছে। এই ধর্মগ্রন্থ তারা যেমন ভক্তিভরে পাঠ করেছে, তেমনি টীকা-টিপ্পনী সংযোজন করে সে গ্রন্থের যাবতীয় ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনেরও প্রয়াস চালিয়েছে। শুধু তাই নয়, ধর্মগ্রন্থের বিরুদ্ধে সামান্যতম সমালোচনাকেও তারা ‘পাপ’ বলে গণ্য করতে ছাড়েননি। এই বিষয়ে, পুরোহিতেরা ছিলেন সবসময়ই সবার উপরে। কেননা, তাঁদের পক্ষে সম্পূর্ণ বাইবেল ভালোভাবে জানার সুযোগ ছিল বেশি। পক্ষান্তরে, বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ ধর্মীয় ভাষণ কিংবা বিভিন্ন উপাসনা উপলক্ষে বাইবেলের নির্বাচিত অংশের পাঠ শুনেই নিজেদের ধন্য মনে করেছেন।
কোনো ধর্মগ্রন্থের উপর বিশেষভাবে কোনো গবেষণা পরিচালনাকালে দেখা গেছে যে, এতদ্সংক্রান্ত কোনো সমস্যা যা কখনো কখনো জটিল হয়ে দাঁড়ায়, তার মূল উদ্ঘাটন ও প্রকৃতি বিশ্লেষণের জন্য সেই গ্রন্থের পাঠ বা বাণীর দোষ গুণ বিচারের প্রয়োজন সর্বাধিক। কিন্তু বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের গুণাগুণ বিচারের নামে তথাকথিত গবেষণামূলক যেসব পুঁথি-পুস্তক বাজারে রয়েছে সেগুলো পাঠ করলে নিরাশ হতে হয়।
কারণ, সংশ্লিষ্ট কোনো সমস্যার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এইসব পুস্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনে এমনভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়, লেখক যেন সেই সমস্যা এড়িয়ে যেতে পারলেই বাঁচেন। এসব ক্ষেত্রে যারা ভাবনা-চিন্তার ক্ষমতা রাখেন ও নিরপেক্ষ রায় প্রদানের সাহস দেখাতে পারেন, তারাও কিন্তু নিজেদের আজগুবি ধারণা ও স্ববিরোধিতা ঢেকে রাখতে পারেন না। আরো দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়, যতো তর্কই হোক আর যতো যুক্তিই দেখানো হোক, সেসবের মোকাবেলায় অনেকেই নির্দ্বিধায় বাইবেলের অংশবিশেষকেই প্রামাণ্য দলিল হিসেবে পেশ করেন। তাঁরা বুঝতেও চান না যে, বাইবেলের এইসব বক্তব্য কতোটা ভ্রান্ত ও ধাঁধায় পূর্ণ। তাছাড়া, এইসব লেখক একবারও ভেবে দেখেন না যে, তাদের এই ধরনের যুক্তিহীনতা স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসী শিক্ষিত লোকদের মনোভাবে কি বিরূপ ও ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
বরং, এমনও দেখা গেছে, সামান্য কিছুসংখ্যক লোকই এ যাবত বাইবেলের এসব গোলকধাঁধা চিহ্নিত করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। পক্ষান্তরে, বেশির ভাগ খ্রিস্টান তাঁদের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা সত্ত্বেও বাইবেলের ওইসব অসঙ্গতির ব্যাপারে নির্বিকার থাকেন।
যদিও, সেসব অসঙ্গতি একেবারেই মৌলিক বিষয়-সংক্রান্ত। উল্লেখ্য, বাইবেলের নতুন নিয়মের অন্তর্ভুক্ত সুসমাচারসমূহের সাথে তুলনীয় হতে পারে, এমন ধর্মগ্রন্থ মুসলমানদেরও রয়েছে, তাহলে ও হাদীস গ্রন্থ। হাদীস হলো, মোহাম্মদের (দঃ) বক্তব্য ও কার্যবিবরণীর সংকলন। যীশুর বাণী ও কর্মবিবরণীর সংকলন হিসেবে বাইবেল। অর্থাৎ, নতুন নিয়মের সুসমাচারসমূহ : ইঞ্জিল হলো খ্রিস্টানদের অনুরূপ ধর্মগ্রন্থ। যীশুর আবির্ভাবের কয়েক দশক পরে যেমন বাইবেলের সুসমাচারসমূহ লিপিবদ্ধ হয়েছিল, তেমনি হাদীসও লিপিবদ্ধ হয়েছিল। মোহাম্মদের (দঃ) মৃত্যুর কয়েক দশক পর হাদীস ও বাইবেল উভয়ের মধ্যেই রয়েছে অতীতের ঘটনাবলীর মানবীয় সাক্ষ্য। পক্ষান্তরে, অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রামাণ্য বাইবেলের (সুসমাচারসমূহ) রচয়িতারা নিজেরা কিন্তু লিপিবদ্ধ ঘটনার কিংবা কোনো বিবরণের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না। এই পুস্তকে আলোচিত হাদীসের সংকলকদের ব্যাপারেও একথা প্রযোজ্য।
এখানেই হাদীস ও বাইবেলের তুলনামূলক আলোচনার শেষ। হাদীসসমূহের সঠিকত্ব বা নির্ভুলতা নিয়ে অতীতে বহু বিচার, বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। পক্ষান্তরে, খ্রিস্টীয় প্রথম শতকেই গির্জার অধিকারীবৃন্দ বহুসংখ্যক সুসমাচার থেকে যাচাই-বাছাই করে শুধু চারটি সুসমাচারকে প্রামাণ্য বলে চূড়ান্তভাবে রায় দিয়েছেন। অথচ, বাইবেলের নতুন নিয়মে সংকলিত সেই চারটি প্রামাণ্য সুসমাচারে বর্ণিত বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে অনেক বিষয়ে তেমন কোনো ঐকমত্য সৃষ্টি হয় না। তবুও, ওই চারটিকে ‘প্রামাণ্য’ বলে গ্রহণ করে বাদবাকি সুসমাচারকে ‘বাতিল’ বলে রায় দেয়া হয়। এভাবে বাতিলকরণের এই প্রক্রিয়া থেকেই ‘এ্যাপোক্রাইফা’ টার্মের উৎপত্তি।
ধর্মগ্রন্থের ব্যাপারে খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামের মধ্যে আর একটি মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান ও খ্রিস্টানদের এমন কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই যার বাণীসমূহ সরাসরি ওহী বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে প্রাপ্ত এবং যে গ্রন্থে বাণীসমূহ হুবহু লিপিবদ্ধ। পক্ষান্ত রে, ইসলামের কোরআন এই চরিত্রের ধর্মগ্রন্থ, এই গ্রন্থ সরাসরিভাবে প্রত্যাদেশের মাধ্যমে প্রাপ্ত।
রআন প্রধান ফিরিশতা জিব্রাঈলের মাধ্যমে মোহাম্মদ (দঃ) কর্তৃক প্রাপ্ত ওহী তথা আল্লাহর বাণী। প্রত্যাদেশপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ওহীর বাণীসমূহ লিখে রাখা হত; বিশ্বাসীরা তা কণ্ঠস্থ করে ফেলতেন এবং নামাজে সেইসব বাণী বা আয়াত তেলাওয়াত করা হত যা এখনো হয়। বিশেষত, প্রাপ্ত বাণীসমূহ রমজান মাসে অবশ্যই সম্পূর্ণভাবে তেলাওয়াতের ব্যবস্থা থাকতো। এখনো সেই ধারা চালু রয়েছে। মোহাম্মদ (দঃ) নিজেই প্রাপ্ত বাণীসমূহ বিভিন্ন সূরায় ভাগ করে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর পরে এইসব সূরা সংগ্রহ করে তা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হয়েছে।