রোমান ক্যাথলিক বিশ্বাস ও ইসলামের মধ্যে ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে এই যে পদক্ষেপ, তা কিন্তু এখানেই থামেনি, বরং পরবর্তীতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও যৌথ বৈঠকের মাধ্যমে তা আরো গতিশীল ও আরো সুদৃঢ় করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অবশ্য, সংবাদপত্র, রেডিও-টেলিভিশনের দ্বারা তো বটেই অন্যান্য প্রচারমাধ্যমের সকল সুযোগ-সুবিধা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য জগতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এইসব ঘটনা তেমন কোনো প্রচার পায়নি।
ভ্যাটিক্যানের নন-ক্রিশ্চিয়ান এ্যাফেয়ার্স দফতরের প্রেসিডেন্ট কার্ডিনাল পিগনোডেলি ১৯৭৪ সনের ২৪ এপ্রিল সরকারি সফরে সৌদি আরব যান এবং বাদশাহ ফয়সালের সাথে সাক্ষাৎ করেন, এই সংবাদটিও পত্র-পত্রিকায় তেমন কোনো প্রচার পায়নি। এ সম্পর্কে ফরাসি সংবাদপত্র লে মডেতে কয়েক ছত্র সংবাদ প্রকাশ করেছিল, তারিখটি ২৫শে এপ্রিল ১৯৭৪। ওই সংবাদসূত্রে জানা যায়, ইসলামী বিশ্বের প্রধানতম নেতা মহামান্য বাদশাহ ফয়সালের নিকট মহামান্য পোপ ৪র্থ পল এই মর্মে এক বাণী পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করেন, এক আল্লাহর আনুগত্যের ভিত্তিতে ইসলামী বিশ্ব ও খ্রিস্টান-জগৎ ঐক্য গড়ে তুলতে পারে।”
ঘটনার গুরুত্ব এই বাণীর মর্ম থেকেই উপলব্ধি করা যায়।
উল্লেখ্য, এর কয়েক মাস পর সৌদী আরবের গ্র্যান্ড উলেমা এক সরকারি সফরে ভ্যাটিক্যানে আসেন এবং পোপ তাকে সাদর অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। এই উপলক্ষে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে এক আলোচনা-বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার শিরোনাম ছিল ‘ইসলামে মানুষের সাংস্কৃতিক অধিকার’। ভ্যাটিক্যানের সংবাদপত্র ‘অবজারভেটর রোমানো’ ১৯৭৪ সনের ২৬ অক্টোবর প্রথম পৃষ্ঠায় এই ঐতিহাসিক বৈঠকের বিবরণ প্রকাশ করে।
উল্লিখিত বৈঠকের সমাপ্তি অধিবেশনে রোমের সাইনড অব বিশপবর্গ উপস্থিত ছিলেন কিন্তু এই সমাপ্তি অধিবেশনের সংবাদটি প্রথম অধিবেশনের তুলনায় ছোট করে ছেপেছিল।
সৌদি আরবের গ্রান্ড ওলেমাকে এরপর সংবর্ধনা জানান, জেনেভা গির্জাসমূহের এডুমেনিকাল কাউন্সিল এবং স্ট্রাসবুর্গের লর্ড-বিশপ মহামতি এলাচিংগার। বিশপ তাঁর উপস্থিতিতেই গ্রান্ড উলেমাকে গির্জাতে জোহরের নামায আদায় করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। অনুমান করা চলে, ধর্মীয় গুরুত্ব হিসেবে নয় বরং বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘটনার বিবরণী হিসেবে সংবাদপত্রগুলোতে ওইসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। কেননা, এসব ঘটনার মধ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো সম্পর্কে ড. মরিস বুকাইলি যাদেরই প্রশ্ন করেছেন, জেনেছেন, তাঁদের অনেকেই এর গুরুত্ব সম্পর্কে তেমন সচেতন নন।
ইসলাম সম্পর্কে পোপ চতুর্থ পল এই যে উদার দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছেন, নিঃসন্দেহে তা দুই ধর্মের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার পথে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে যা দৃষ্টান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
পোপ নিজেই এ ব্যাপারে বলেন যে, “এক আল্লাহর উপাসনার ভিত্তিতে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে এক সুগভীর বিশ্বাস তাকে পরিচালিত করেছিল।”
ক্যাথলিক চার্চের প্রধানের কাছ থেকে মুসলমানদের জন্য এরকম মানসিক ভাবাবেগের সত্যি প্রয়োজন রয়েছে। কেননা, বেশিরভাগ খ্রিস্টানই বড় হয়ে থাকেন ইসলাম-বিরোধিতার বিদ্বেষপূর্ণ এক উদ্দীপনার মধ্যে। ফলে, তাঁরা আদর্শের প্রশ্নে ইসলামের নামগন্ধ পর্যন্ত বরদাশত করতে রাজি নন। ভ্যাটিক্যান থেকে প্রকাশিত উল্লিখিত পুস্তকে এ জন্যে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে।
এ কথা অনস্বীকার্য নয়, উল্লিখিত বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবের জন্যেই সত্যিকারার্থে ইসলাম যে কি, তা বেশিরভাগ খ্রিস্টান সম্পূর্ণভাবেই অজ্ঞাত থাকেন। একই কারণে ইসলামী-প্রত্যাদেশ সম্পর্কে তাদের ভ্রান্তিপূর্ণ ধারণা রয়ে গেছে।
যাহোক, স্বাভাবিকভাবেই একত্ববাদী কোনো একটি ধর্মের প্রত্যাদেশ সংক্রান্ত কোনো বিষয় যখন পর্যালোচিত হয় তখন এ বিষয়ে অপর দুই একত্ববাদী ধর্মের বক্তব্য কি, তার তুলনামূলক আলোচনাও এসে পড়ে।
তাছাড়া, যেকোনো সমস্যার সার্বিক বিচার-পর্যালোচনা বিচ্ছিন্ন কোনো আলোচনার চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়। এ কারণে ড. মরিস বুকাইলি মন্তব্য করেন,
“যেসব বিশেষ বিষয়ে ধর্মীয় গ্রন্থসমূহের বক্তব্যের সাথে বিশ-শতকের বৈজ্ঞানিক সত্যের বিরোধ রয়েছে বলে মনে করা হয়, সেসবের পর্যালোচনায়ও উল্লিখিত তিন ধর্মের কথা এসে যায়। সকলের এই সত্যও অনুধাবন করা প্রয়োজন যে, বস্তুবাদের সুতীব্র অভিযানের মুখে তিন ধর্মই আজ হুমকির সম্মুখীন, এই যখন অবস্থা, তখন পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের গুণে ধর্ম তিনটি সহজেই সমবেতভাবে একটি সুদৃঢ় প্রতিরোধ-প্রাচীন গড়ে তুলতে পারে। বিজ্ঞান এবং ধর্ম পরস্পরবিরোধী বলে যে ধারণা, তা ইহুদী ও খ্রিস্টান-অধ্যুষিত দেশগুলোতে যেমন, তেমনি মুসলিম বিশ্বের কোনো কোনো মহলে বেশ জোরদার। কেন এই অবস্থা–সে প্রশ্নের সার্বিক জবাব খুঁজে পাওয়ার জন্য দীর্ঘতর আলোচনা প্রয়োজন।
প্রকৃতপক্ষে, এই পর্যালোচনা তথা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে অগ্রসর হওয়ার আগে একটি মৌলিক প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে নিতে হবে। সেই প্রশ্নটি হচ্ছে, ধর্মগ্রন্থের লিপিবদ্ধবাণীসমূহ কতোটা সঠিক? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে যে অবস্থা ও যে পরিবেশে এসব বাণী লিপিবদ্ধ হয়েছিল তা যেমন পরীক্ষণীয়; তেমনি এও পরীক্ষণীয় যে, কার মাধ্যমে বা কোন পথে এসব বাণী মানুষের কাছে পৌঁছেছে।