পক্ষান্তরে, যীশু ঐ ব্যাখ্যার সাথে এই বাণীও প্রচার করতে থাকেন যে, স্বর্গ রাজ্য (Kingdom Of God) প্রতিষ্ঠার জন্যেই তিনি প্রেরিত হন। সেই স্বর্গরাজ্যে প্রবেশের অধিকার সবারই রয়েছে। ফলে ক্রমশঃ অধিকসংখ্যক লোক যীশুর অনুগামী হতে থাকে। আর বিপথগামী বকধর্মীয় দল যীশুর বাণীর অপব্যাখ্যায় মেতে উঠে। পরিশেষে, যীশুর সাথে তর্কে পেরে না উঠে তারা নিজেদের মধ্যে যীশু-বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। তারা প্রচার করতে থাকে যে, যীশু ইহুদীদের ধর্মশাস্ত্রগুলোর নিন্দে করেন, জেরুজালেমের ধর্ম-মন্দির ভেঙ্গে তিনদিনে তা পুনঃনির্মাণ করে দিতে পারেন; এরূপ উক্তি তিনি করে থাকেন। খোদার পুত্র এবং ইহুদীদের রাজা হওয়ার দাবীও তিনি করে থাকেন, ইত্যাদি।
ইহুদী আলেমরা কিছুকাল ধরে নিজেদের মধ্যে এ আন্দোলন চালানোর পরে প্রথমত নিজেরাই যীশুকে হত্যা করার চেষ্টা করে (যোহন, ৫: ১৮)। কিন্তু যীশুর সমর্থক ও আইনের ভয়ে যখন তারা তাকে হত্যা করতে অসমর্থ হয় (মথি, ২১ : ৪৬) তখন তারা বিভিন্ন ফেরকার আলেমদের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করে (মথি, ২৭:১) তারপর আঞ্চলিক শাসনকর্তা পীলাতের কাছে এ ধরনের অভিযোগ পেশ করতে থাকে যে
(১) যীশু রাজদ্রোহী, নিজেকে তিনি ইহুদীদের রাজা বলে ঘোষণা করেন, রাজকর দিতে লোকদের নিষেধ করেন;
(২) ধর্ম হিসেবে তিনি একজন ফাছক (Corruptor), ইহুদীদের পবিত্র ধর্ম মন্দির সম্বন্ধে অবৈধ আক্রমণ করতে এবং নিজেকে খোদার পুত্র বলে ঘোষণা করতেও তিনি কুণ্ঠিত হন না, ইত্যাদি। এসব অপরাধের জন্য তাঁকে ক্রুশে টাঙ্গিয়ে নিহত করা হোক। কিন্তু পীলাত যীশুকে গ্রেফতার করার আদেশ না দেয়ায়, একদিন ইহুদী প্রধানরাই অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যীর বাসস্থান আক্রমণপূর্বক তাকে ধরে নিয়ে পীলাতের আদালতে উপস্থিত করে, যাতে রাজ দরবারের বিচারে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে ক্রুশে টাঙ্গিয়ে নিহত করা যায়।
কিন্তু ‘যীশু ক্ৰশে নিহত হয়েছিলেন’–রক্ষণশীল খ্রিস্টানচার্চগুলোর এই বুনিয়াদি প্রচারণাটি যে উদ্দেশ্যমূলক এবং কল্পিত উপাখ্যান ব্যতীত আর কিছুই নয় পরবর্তী আলোচনাক্রমে তা জানা যাবে।
বাইবেলের সাক্ষ্য অনুযায়ী যীশু ক্রুশে প্রাণত্যাগ করেননি:
যারা বাইবেল পাঠ করেছেন তারা অবগত আছেন যে, সুসমাচার রচয়িতারা যীশুর জীবনেতিহাস সংকলনের সময় তাঁর কার্যকলাপের সমর্থনের জন্য মোশির ব্যবস্থা বা পুরাতন নিয়মের অনেক উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। এই পুরাতন নিয়মে স্পষ্টাক্ষরে লিখিত আছে:
“এবং যদি কোন ব্যক্তি প্রাণদণ্ডের যোগ্য পাপ করে আর তার প্রাণদণ্ড হয়, আর তুমি তাকে গাছে (ক্রুশে) টাঙ্গিয়ে দেও, তবে তার শব রাতে গাছের (ভুশের) উপর থাকতে দেবে না, পরন্তু সেদিনই তুমি তাকে কবর দেবে, কেননা যে ব্যক্তিকে (কাষ্ঠে) টাঙ্গানো হয় সে ঈশ্বরের শাপগ্রস্ত; তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু যে ভূমিকে তোমার উত্তরাধিকার সূত্রে দান করেছেন; তুমি তাকে অশুচি করবে না।” (দ্বিতীয় বিবরণ, ২১ : ২২-২৩)।
উদ্ধৃত পদ দুটোর অনুবাদে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বেশ কিছুটা কারচুপি করার প্রয়াস চালানো হয়েছে। তাই প্রকৃত তাৎপর্যটি বুঝিয়ে দেবার জন্য বন্ধনীর মধ্যে “ক্রুশ” এবং “কাষ্ঠে” শব্দ দুটো বাড়িয়ে দেয়া হল।
কারণ, আরবি বাইবেলে এ শব্দ দুটো রয়েছে। আরবি অনুবাদে ‘খাছীবুহু শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যার আভিধানিক অর্থ, কাষ্ঠনির্মিত কোন পদার্থ। ইস্রায়ীলীদের ধর্মীয় পরিভাষায় এর অর্থ ‘ছালীব’ বা ক্রুশ-কাষ্ঠ। একজন বিখ্যাত খ্রিস্টান অভিধানকার বলেছেন,
“যে মহিমান্বিত কাঠের উপর প্রভু যীশুখ্রিস্টকে ক্রুশে দেয়া হয়, তাকে (আরবিতে) ছালীব বলা হয়, কিন্তু আমাদের পরিভাষায় মাছব বলতে প্রভু ঈসা মসীহকে বুঝিয়ে থাকে।” (আকরাবুল-মাওয়ারিদ)।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, ক্রুশ-কাষ্ঠের উপর যাদের মৃত্যু হয়, তাদের প্রত্যেক ব্যক্তিই আল্লাহ কর্তৃক অভিশপ্তরূপে পরিগণিত হয়। এমনকি তার মৃতদেহকে এমন অশুচি বলে গণ্য করা হয় যে, তার সংশ্রবে বনি-ইস্রায়ীলের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পবিত্র ভূমিগুলো পর্যন্ত কলুষিত হয়ে যায়। অথচ, খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকরা সমবেতকণ্ঠে ঘোষণা করে আসছেন যে, যীশুখ্রিস্টকে ক্রুশে দিয়ে নিহত করা হয়েছিল। কারণ, তা না হলে খ্রিস্টধর্মের মূল ভিত্তিটিই স্বতঃসিদ্ধরূপে ও সম্পূর্ণভাবে নস্যাৎ হয়ে যায়। কিন্তু এ রকম তথ্যের মাধ্যমে খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের হয় স্বীকার করতে হবে যে, কুশে মৃত্যু হওয়ায় যীশু আল্লাহর নির্দেশমতে অভিশপ্ত ও অশুচি হয়েছেন; না হয় বলতে হবে যে, যীশু ক্রুশের উপর মৃত্যুবরণ করেননি। প্রথমাবস্থায় তাদের বর্ণিত যীশুর সমস্ত বৈশিষ্ট্য একেবারে নস্যাৎ হয়ে যায়, দ্বিতীয়াবস্থায় বাইবেলের সামগ্রিক বর্ণনাগুলোই মিথ্যে বলে প্রতিপন্ন হয়।
এখন, যীশু যে আদৌ ক্রুশে প্রাণত্যাগ করেননি, তার কয়েকটি স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণ বাইবেল থেকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে–
১। ধর্মগুরু ও ফরীশীরা যখন যীশুকে তার সত্যতার প্রমাণস্বরূপ কোন একটি মোজেযার দাবী করেছিল, তখন তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, তার ক্ষেত্রে যোনা ভাববাদীর নিদর্শন দেখানো হবে। যেমন, ক’জন ধর্মগুরু ও ফরীশী তাকে বললেন, শুরু আমরা আপনার প্রদর্শিত একটি লক্ষণ দেখতে চাই। তিনি উত্তরে তাদের বললেন, “এ যুগের দুষ্ট ও ভ্রষ্টচারী লোকেরা লক্ষণের অন্বেষণ করে, কিন্তু ভাববাদী যোনার লক্ষণ ছাড়া আর কোন লক্ষণ এদের নিকট প্রদর্শিত হবে না। কারণ, যোনা যেমন তিনদিন-তিনরাত্রি তিমি মাছের উদরে ছিলেন, মনুষ্যপুত্রও তেমনি তিনদিন-তিনরাত্রি পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকবেন।” (মথি, ১২ : ৩৮-৪০)।