এভাবে হযরত মুসা (আঃ) এসেছিলেন ইহুদী জাতিকে মিসর-রাজ ফেরাউনের শোচনীয় দাসত্ব-শৃঙ্খল থেকে উদ্ধার করে তাদের পুরানো আবাসভূমিতে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দিতে। কিন্তু হযরত মুসা (আঃ) ও তাঁর সহকারী হযরত হারুন (আঃ) এবং ইস্রায়ীলবংশীয় অন্যান্য নবীদের সাধনা নানাকারণে পূর্ণসিদ্ধিলাভে ব্যর্থ হয়।
এ অবস্থায়, অজ্ঞাতকারণে এবং নিতান্ত অজ্ঞাত স্থানে হযরত মুসা (আঃ) এর মৃত্যু হয়। কালক্রমে ইহুদী জাতির নিজ কর্মফলে তাদের জাতীয় জীবন বিভিন্ন পাপে-তাপে আচ্ছন্ন হয়ে যায়, তাঁদের পবিত্র ধর্মস্থান জেরুজালেম পর্যন্ত পরজাতির দ্বারা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়ে; পুনঃপুনঃ তাদের ধর্মশাস্ত্রগুলো ভস্মীভূত করা হয়। যে কারণে বনি-ইস্রায়ীল জাতি আবার যে গোলামের জাতি, সেই গোলামের জাতিতেই পরিণত হয়ে পড়ে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, হযরত ইয়াকুব (আঃ) বা ইস্রায়ীল (আঃ)-এর বারোজন পুত্র-সন্তান ছিল। এই বারোজন পুত্রের সন্তানেরা বারোটি গোত্রে বিভক্ত হয়ে পরবর্তীকালে ইস্ৰায়ীলের দ্বাদশ গোত্র’ নামে পরিচিত হয়। এরা ব্যাবিল-রাজ নাবুক নাসর (Nebuched-nezzer) কর্তৃক বারবার আক্রান্ত হয়ে অবশেষে খ্রিঃ পূঃ ৫৮৬ সালে বন্দী ও বিতাড়িত হয়ে ব্যাবিলনে আনীত হয় এবং সেখানে তারা নাবুক নাসর ও তার বংশধরদের দাসত্ব-শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয় (২১ বংশাবলী, ৩৬ : ২০)। তারপর সাইরাস (Cyrus) রাজ ব্যাবিলন দখল করলে তার অনুমতিক্রমে তাঁদের দুটি গোত্র, ফিলিস্তিনে গিয়ে পুনরায় বসবাস শুরু করে এবং পরে পারস্য-রাজ দারিয়ুস (Darius) ব্যাবিলন দখল করলে এবং তাঁর রাজ্য ভারতের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হলে বনি-ইস্রায়ীলের অপরাপর দশটি গোত্র নাসিবিনের পথধরে পারস্যের উপর দিয়ে আফগানিস্তান, লাদাখ, তিব্বত, কাশ্মীর ও মধ্যভারতে চলে আসে এবং সেখানে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। Apocrypha থেকে জানা যায়, তারা কখনো তাদের দেশে প্রত্যাবর্তন করেনি (2 Esdres, 13: 29-36)। আল্লাহতায়ালা বনি-ইস্রায়ীলের এই হারানো গোত্রগুলোকে একত্র এবং পুনরায় সংহত করার জন্যে এবং তৌরাতের ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ করার প্রধান উদ্দেশ্যে হযরত ঈসা (আঃ) বা যীশুকে প্রেরণ করেন। ফিলিস্তিনে বনি-ইস্রায়ীলের মাত্র দুটো গোত্রের মধ্যে। তাই যীশু বলতেন,
“আমার আরও মেষ আছে, সে সকল এ খোয়াড়ের নয়, তাদেরকে আমার আনতে হবে এবং তারা আমার কথা শুনবে, তাতে এক পাল ও এক পালক হবে (যোহন, ১০ : ১৬)।
তিনি আরও বলতেন, “আমাকে অন্যান্য নগরেও ঈশ্বর-রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করতে হবে, কারণ সে জন্যেই আমি প্রেরিত হয়েছি।” (লুক, ৪ : ৪৩)।
বাইবেল পাঠান্তে জানা যায়, যীশু কোন নতুন ধর্মমত আনেননি, মোশির বিধি-ব্যবস্থার কোনপ্রকার পরিবর্তন ঘটাতেও তিনি আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। কেননা, তিনি বলতেন,
“মনে করো না যে, আমি বিধি-ব্যবস্থা অথবা নবীদের আনীত গ্রন্থ বিলুপ্ত করতে এসেছি। আমি তাকে লোপ করতে আসিনি, বরং তাকে পরিপূর্ণ করতে এসেছি।” (মথি, ৫:১৭)
যীশু যে বনি-ইস্রায়ীল ছাড়া অন্য কোন জাতির নিকট প্রেরিত হননি, সে সম্বন্ধে বাইবেল বলে–
“আর সে স্থান ছেড়ে যীশু সোর ও সীদোন অঞ্চলে চলে গেলেন। আর সেই অঞ্চলের একজন কেনানীয় মহিলা এসে চিৎকার করে তাঁকে বলল, ‘প্রভু, দায়ুদ-সন্তান, আমার প্রতি দয়া করুন, আমার কন্যাটি নিদারুণভাবে মন্দ-আত্মা-বিষ্ট হয়েছে।”
কিন্তু, তিনি তাকে কোনও উত্তর দিলেন না। তাঁর শিষ্যেরা নিকটে এসে তাঁকে অনুরোধ করে বলেন, মহিলাটিকে বিদায় করুন, কারণ সে চিৎকার করতে করতে আমাদের পিছু পিছু এসেছে। তিনি উত্তরে বললেন, ইস্রায়ীল-কুলের হারানো মেষ ছাড়া আর কারও নিকট আমি প্রেরিত হইনি’। মহিলাটি কিন্তু এসে, তাঁকে প্রাণিপাত করে বলল, ‘প্রভু, আমায় সাহায্য করুন’। তিনি উত্তরে বললেন, ‘সন্তানদের খাদ্য নিয়ে কুকুরের কাছে ফেলে দেয়া সঙ্গত নয়।” (মথি ১৫ : ২১-২৬)।
অন্য এক কারণে যীশু শিষ্যদেরকে সাবধান করে বললেন,
“পবিত্র বস্তু কুকুরকে দিয়ো না; তোমাদের মুক্তা কুরের সামনে ছড়িয়ো না …।” (মথি, ৭: ৬)।
বাইবেলের এসব সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, মোশির বা অন্যান্য ভাববাদীদের প্রবর্তিত বিধি-ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন কিংবা ইহুদী ব্যতীত অন্য কোন লোক সমাজের কাছে ধর্ম প্রচার করার কোন সংকল্প যীশুর ছিল না। ইস্রায়ীল-বংশের হারানো পোত্র দশটি উদ্ধার করাই ছিল তাঁর নবী-জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য।
যিশুর বিরুদ্ধে ইহুদীদের আন্দোলন:
ইহুদীরা যখন তাওরাতের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী প্রতিশ্রুত একজন ত্রাণকর্তা, ‘মসীহ’র অপেক্ষা করছিল, ঠিক তখনই যীশু আবির্ভূত হয়ে ঘোষণা করলেন, বনি-ইস্রায়ীলের হারানো গোত্রগুলোকে একত্রিত ও পুনঃসংহত করার প্রধান উদ্দেশ্যে আল্লাহতায়ালা তাকে মনোনীত করেছেন। কিন্তু, এই ঘোষণায় স্থানীয় ইহুদীদের কয়েকজন লোক ছাড়া কেউ তাঁকে বিশ্বাস করলো না; বরং তার বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হল। কারণ, তারা বিশ্বাস করতো যে, মালাকী নবী (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী প্রতিশ্রুত মসীহ’র আবির্ভাব হবে ইলিয়াস (ইদ্রিস) নবী (আঃ)-এর আগমনের পরে (মালাকী ৪:৫) তাওরাতের বর্ণনানুযায়ী ইলিয়াস নবী (আঃ) রথযোগে জীবিতাবস্থায় আকাশে উড়ে গেছেন (২ রাজাবালী, ২: ১১)। সুতরাং, আকাশ থেকে যখন তাঁর পুনরাগমন হয়নি, তখন প্রতিশ্রুত মসীহও আসতে পারেন না। কিন্তু, যীশু তাদের পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন, আকাশ থেকে নবী নেমে আসা অসম্ভব, এটা একটি ভ্রান্ত ধারণা। বরং তোমরা যদি গ্রহণ করতে সম্মত হও তবে জানবে যে যোহন বা ইয়াহইয়া নবীই ‘এলিয়’ (মথি, ১১ : ১৪) কারণ, ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, “তিনি এলিয়’র আধ্যাত্মিকতা ও শক্তি নিয়ে মসীহ্’র পূর্বে আগমন করবেন” (লুক, ১ : ১৭) কিন্তু ইহুদীরা যীশুর এ ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারেনি। তাদের ধারণায় ‘এলিয়’ স্বয়ং আকাশ থেকে অবতীর্ণ হবেন, অন্যকোন ব্যক্তি এলিয়ের রূপ ধরে বা আধ্যাত্মিকতা নিয়ে আসবে না। সুতরাং, মরিয়ম পুত্র একজন প্রতারক এবং ভ্রান্তপথ প্রদর্শনকারী।