খ্রিস্টান পণ্ডিতরা এভাবে কলেমা বা বাক্য শব্দের যে বিকৃত অনুবাদ করেছেন এবং গ্রীক দার্শনিকদের অনুকরণ করে যোহন এ অনুবাদে যেমন অন্যায়ভাবে যীশুকে ঈশ্বররূপে প্রবেশ করিয়েছেন, পূর্বোক্ত উদ্ধৃতাংশ থেকে তার সম্যক পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু, এসব জানা সত্ত্বেও খ্রিস্টধর্ম প্রচারকগণ আলোচ্য কলেমা শব্দকে অবলম্বন করে বলতে চান যে, কোরআনও যীশুর অনাদি ও ঈশ্বরত্ব বা খোদাত্ব হওয়ার কথা স্বীকার করে নিয়েছে। তাই প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করে দেয়ার জন্য এ অবান্তর প্রসঙ্গের অবতারণা করতে হল। মূলতঃ পবিত্র কোরআনের ৩: ৪৫ আয়াতে কলেমা’ শব্দ ব্যবহার করে যোহন প্রভৃতির প্রবর্তিত বিকারের মূল ইতিহাসের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে এবং দৃঢ় ও সুস্পষ্ট ভাষায় তার প্রতিবাদ জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, যীশু শাশ্বত ও স্বয়প্রকাশ নন। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্’র নির্দেশ অনুসারে, অন্যান্য মানুষের মত তাকেও জন্মগ্রহণ করতে হয়েছে।
পরিশেষ : “ত্রিত্ববাদ’ এবং যীশুখ্রিস্টকে খোদার পুত্র খোদা বলার খ্রিস্টানদের কল্প-কাহিনী সম্বন্ধে ত্রিত্ববাদ ও যীশু’ আখ্যায় এই অধ্যায়ে যা আলোচিত হয়েছে, তা পবিত্র কোরআনের সেইসব আয়াতের ব্যাখ্যাস্বরূপ, বলা হয়েছে :
“তারা নিশ্চয় (যীশুর শিক্ষায়) অবিশ্বাসী, যারা বলে, আল্লাহ হলেন তিনের মধ্যে তৃতীয়, অথচ আর কোন খোদাই নেই একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া।”–৫: ৭৪)
“নিশ্চয় তারা (প্রকৃত খোদায়) অবিশ্বাসী, যারা বলে মরিয়ম-পুত্র মসীহই খোদা; অথচ মসীহ্ বলেছিলেন, হে বনি-ইস্রায়ীল! উপাসনা কর আল্লাহর যিনি আমার ও তোমাদের প্রভু।–৫ : ৭৩)
“এবং তারা বলে আল্লাহ্ পুত্র গ্রহণ করেছেন, অথচ পবিত্র তিনি এথেকে।”–(২ : ১১৭)।
“নিশ্চয় যীশুর দৃষ্টান্ত আল্লাহ্র নিকট আদমের দৃষ্টান্তস্বরূপ।” (৩: ৬০)
যীশু কি আদৌ ক্রুশে নিহত হয়েছিলেন:
রক্ষণশীল খ্রিস্টান চার্চগুলো অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে সাধু পৌলের যুগ থেকে প্রচার করে আসছে যে, যীশুখ্রিস্ট ক্রুশে নিহত হয়েছিলেন। কেননা, ক্রুশে নিহত করতে না পারলে তার দ্বারা পৃথিবীর সমস্ত পাপীর প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাওয়ার চমকপ্রদ তত্ত্বটি অর্থাৎ সাধু প্রতারণাটা একেবারে পণ্ড হয়ে যায়; অন্যদিকে, ইহুদীদের দায়ুদের সিংহাসন অধিকারের রাজনৈতিক প্রলোভনটিও মাঠে মারা যায়। সেক্ষেত্রে, যীশুর ক্রুশে নিহত হওয়ার কাহিনীটি শুধু খ্রিস্টানদের কাছেই নয়, ইহুদীদের কাছেও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
এছাড়া, বিষয়টি এখন মুসলমানদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। কেননা, ইহুদীরা দাবী করে, যীশুকে তারা ক্রুশে নিহত করে মিথ্যেবাদী ও অভিশপ্ত প্রমাণ করেছে।
পক্ষান্তরে, খ্রিস্টানরা এ বিষয়ে একমত হয়েও এক বিশেষ মতভেদ রাখে যে, যীশু তাঁর অনুসারীদের যাবতীয় পাপের বোঝা নিজের দায়িত্বে গ্রহণ করে তার প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ ক্রুশে আত্মোৎসর্গ করেছেন। কিন্তু মুসলমানদের পবিত্র কোরআন দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছে :
“এবং তাদের এ কথা বলার কারণে, আমরা আল্লাহর রসূল মরিয়ম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি, অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি, কুশে বিদ্ধ করেও নিহত করেনি; কিন্তু তাদের নিকট দ্রুপ সদৃশই করা হয়েছিল; আর নিশ্চয় যারা তার সম্বন্ধে মতভেদ করে তারা সন্দেহে অভিভূত, এ সম্বন্ধে তাদের কোন নিশ্চিত জ্ঞান নেই, আছে শুধু অনুমানের অনুসরণ এবং তারা তাকে নিশ্চিতভাবে হত্যা করতে পারেনি। বরং, আল্লাহ তাঁকে নিজের দিকে উন্নীত করেছেন; বস্তুতঃ আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, পরম প্রজ্ঞাময়। এবং আহলে কিতাব (ইহুদী ও খ্রিস্টান)-দের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তি নেই, যে নিজ মৃত্যুর পূর্বে তাতে বিশাস না রাখে, অথচ কিয়ামতের দিনে সে (ঈসা) তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হবেন।” (সূরা নিসা, ১৫৭-১৫৯ আয়াত)।
প্রকৃতপক্ষে, ইহুদী ও খ্রিস্টান জাতির সমবেত দাবির বিরুদ্ধে পবিত্র কোরআন দৃঢ় ও স্পষ্টভাষায় ঘোষণা করছে,
“ইহুদী ও খ্রিস্টান জাতি যীশুর অভিশপ্ত মৃত্যু এবং প্রায়শ্চিত্তবাদ সম্বন্ধে যে-সব কল্পকাহিনী প্রচার করে আসছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যে, যীশুকে তারা কুশে দিয়ে অথবা অন্য কোনপ্রকারেও হত্যা করতে পারেনি। বরং, আল্লাহ্ তাকে স্বীয় পরাক্রম দ্বারা অভিশপ্ত মৃত্যু থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং নবীসুলভ সম্মানজনক ঊর্ধ্বগতি দান করেছেন। কিন্তু, আহলে কিতাবধারী ইহুদী ও খ্রিস্টানরা যীশুকে তার মৃত্যুর পূর্বেই ক্রুশে নিহত কল্পনা করে যে মতভেদ করেছে, তার ভুল কিয়ামতের দিনে তারা বুঝতে পারবে। যেসব ইহুদী যীশুকে অভিশপ্ত কল্পনা করে ইহজগত ত্যাগ করবে তারা নিজে অভিশপ্ত হওয়ার স্বরূপ প্রত্যক্ষ করে নিজ ভুল বুঝবে এবং যেসব খ্রিস্টান যীশুকে ত্রাণকর্তা মেনে অবাধে সকল পাপ করে গেছে বা করবে তারা নিজ নিজ কর্মের জবাবদিহি ও ফলভভাগের মধ্যে নিজ ভূল উপলব্ধি করবে। এভাবে উভয় জাতির বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন যীশু সাক্ষী হবেন।
যীশুখ্রিস্টের আগমনের কারণ : হযরত ইব্রাহিম (আঃ) থেকে শুরু করে হযরত মুসা (আঃ) ও হযরত ঈসা (আঃ) পর্যন্ত যত নবী-রসূল আল্লাহর তরফ থেকে দুনিয়ায় প্রেরিত হন, তাঁদের প্রত্যেকেরই নবুয়তের মিশন ও বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সমসাময়িক পরিস্থিতি অনুসারে এক একটি ভৌগোলিক সীমারেখাও নির্ধারিত হয়েছিল।