মূলত, খ্রিস্টান ব্যাখ্যাকাররা পৌত্তলিকদের প্রীত করতে একদিকে যেমন হযরত যীশুর প্রচারিত তৌহিদীবাদকে এবং তার প্রতি অবতীর্ণ হওয়া আল্লাহর কেতাব ইঞ্জিলকে সম্পূর্ণরূপে বিসর্জন দিয়ে বসলেন, অপরদিকে পৌল নামক ধুরন্ধরের খপ্পরে পড়ে তার আনীত গ্রীক ও পার্সীক দর্শনের সংমিশ্রণে এক অভিনব উদ্ভট ধর্মকে খ্রিস্টানধর্মের নামানুকরণে চালিয়ে দেন। ফলে, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জুলুম করা হয়েছে হযরত যীশুর নবী-জীবনের মহিমার উপর। ইঞ্জিলগুলোতে নানাপ্রকার ভিত্তিহীন গল্প-গুজবের সমাবেশ ঘটিয়ে তা করা হয়েছে।
যীশুকে খোদা বলে প্রতিপন্ন করার জন্য সাধু পৌলের যুগ থেকেই খ্রিস্টান ধর্মের প্রধান প্রবর্তকেরা আল্লাহর নামে মিথ্যা রচনা করেন এবং অন্যান্যপ্রকারে ধর্মশান্ত্রের বিকার ঘটাচ্ছেন। এ শ্রেণীর জাল ও প্রবঞ্চনা তাঁদের পরিভাষায় “Pious fraud” বা সাধু প্রবঞ্চনা বলে কথিত হয়ে থাকে। প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টান সাধুরা এ জাল জুয়াচুরির কথা সগৌরবে স্বীকার করে গেছেন। সাধু পৌল বলেছেন, “কিন্তু আমার মিথ্যায় যদি খোদার সত্যনিষ্ঠতা তাঁর মহিমার উদ্দেশ্যে উৎকর্ষ লাভ করে, তবে পাপী বলে আমার বিচার হয় কেন?” (রোমীয়, ৩ : ৭)। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খ্রিস্টান পাদ্রী পুরোহিতদের এ স্বেচ্ছা প্রণোদিত অনাচারও যে কিরূপ নিষ্ঠুরভাবে প্রচলিত হয়ে এসেছে, পাশ্চাত্য জগতের বহু খ্রিস্টান লেখকের লেখায় এর বিস্তারিত বিবরণ এখন দুনিয়াময় প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু এখন থেকে চৌদ্দশ বছর পূর্বে পবিত্র কোরআন তাদের এই জাল-জুয়াচুরির কথা স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করে দিয়েছে।
এ শ্রেণীর জাল-জুয়াচুরি এবং শাব্দিক ও আর্থিক বিকার সাধন করার পর তারা দুনিয়াকে বুঝাচ্ছে, যীশুকে খোদা বলে বিশ্বাস করতে হবে, স্বয়ং যীশুই এ আদেশ প্রদান করেছেন। পবিত্র কোরআনের ৩ : ৭৮ আয়াতে মানুষের সাধারণ জ্ঞান-বিবেকের দিকথেকে এ দাবীর প্রতিবাদ করে বলা হয়েছে, যীশু মানুষ ছিলেন, তাঁর খোদাত্ব তোমাদের মিথ্যা রচনা। একজন মানুষকে আল্লাহ্ নিজের “বাণী” প্রদান করলেন, সেই বাণীকে সম্পূর্ণভাবে প্রাণগত করার উপযোগী প্রজ্ঞাও তাঁকে দিলেন, আর সাথে সাথে নবুয়তের দায়িত্ব অর্পণ করে তাঁকে আদেশ করলেন সেই বাণীকে ইস্রায়ীল-কুলের কাছে পৌঁছাতে। এমন সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়ার পরও কোন মানুষ নিজের প্রজ্ঞা ও আল্লাহর বাণীর বিপরীত এ ধরনের কথা কখনোই বলতে পারেন না যে আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানুষ তার পূজা করবে। এমনকথা বলা তার পক্ষে অসঙ্গত এবং শোভনীয় নয়। ফলতঃ হযরত ঈসা (আঃ) বা যীশুর পক্ষে ঐ ধরনের কথা বলা কখনোই সম্ভব হতে পারে না। প্রচলিত বাইবেলে তোমাদের উক্তির অনুকূল কিছু থাকলে তা তোমাদের নিষ্ঠুর ধার্মিক জালিয়াতি ছাড়া অন্য কিছু নয়।
একটি ভ্রান্তির অপনোদন প্রয়োজন:
ইজ কালাতিল মালাঈকাতু ইয়া মারইয়ামু ইল্লাল্লাহা উ বাশিরুকী বি কালিমাতিম মিনহু– ইসমুহুল মাসীহু ঈসা ইবনু মারইয়ামা অর্থাৎ অন্য ফেরেশতারা যখন বলেছিল : হে মরিয়ম! আল্লাহ্ তোমাকে নিজ সন্নিধানের একটি কলেমা সম্বন্ধে সংবাদ দিচ্ছেন : তাঁর নাম আল্ মসীহ্ ইসা ইবনু মরিয়ম।
খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকরা পবিত্র কোরআনের উপরোদ্ধৃত (৩ : ৪৫) আয়াতের কলেমা শব্দ দ্বারা মুসলমানদের বুঝাতে চান যে, কোরআনও যীশুর অনাদিস্বরূপ ও খোদাত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু কলেমা’ শব্দের অর্থ বাক্য। এটা আরবি ভাষার একটি ইডিয়ম, অর্থ-সংবাদ বা সন্দেশ। ইমাম রাগিব বলেছেন, ফরমান বা decree মাত্রকেই কলেমা বলা হয়–তা সে বাক্যতঃ হোক আর কার্যত হোক। হযরত ঈসার জন্ম সম্বন্ধে আল্লাহর যে ফরমান, ফয়সালা, নির্দেশ বা decree পূর্ব থেকে নির্ধারিত ছিল ৩ : ৪৫ আয়াতে সাধ্বী মরিয়মকে সেই ফরমানের সংবাদ দেয়া হয়েছে।
কিন্তু, খ্রিস্টান পণ্ডিত-পুরোহিতরা নানাবিকার ও বিপ্লবের পর পবিত্র কোরআনের ৩ : ৪৫ আয়াতের কলেমা’ শব্দকে যীশুর ‘অনাদিস্বরূপ’ অর্থে গ্রহণ করেছেন। কলেমার প্রতিশব্দরূপে বাইবেলের গ্রীক অনুবাদে Logos শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। বাইবেল সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ ও নিরপেক্ষ পাশ্চাত্য পণ্ডিতরাও স্বীকার করেছেন যে, গ্রীক দার্শনিক Heraclituse ও Philo প্রভৃতির অনুকরণ করে যীশুর পরবর্তী খ্রিস্টানরা, বিশেষতঃ যোহন খ্রিস্টানধর্মে এ মতবাদটি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ একে Chistinising of the Logos conception বলে উল্লেখ করতেও কুণ্ঠিত হননি। এ Logos সম্বন্ধে Encyclopaedia Biblica’-এর লেখক J.G, Adolf D. D. ‘Art. Logos-এ বলেন:
চতুর্থ সুসমাচারের প্রস্তাবনা অংশ ছাড়া বাইবেলে উল্লিখিত আচার আচরণের কোন বৈচিত্র্য নেই; এ থেকে কেবল কোন বাক্য বা কোন ধারণার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দের জটিলতাকেই বুঝায়। ‘the logos of God’ পূর্ণাঙ্গ সুসমাচারকেই বলা যায়, অথবা আরও সহজ করে বললে বলতে হয় “বিমূর্ত স্বর” (The logos)।
প্রবন্ধের উপসংহারে লেখক আরও বলেন, দুর্ভাগ্যবশতঃ দ্বিতীয় শতাব্দীর মত সুদূর অতীতেও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকেরা ঐশ্বরিক সুসমাচারের ঐতিহাসিক বর্ণনার প্রসঙ্গের চেয়ে তার দার্শনিক উপাদানের প্রতি বেশি গুরুত্ব আরোপ করতেন। আর বর্তমান লেখক বিমূর্ত বাণীর বিষয়টিকে এভাবে প্রকাশ করার সুযোগ গ্রহণ করায় বিষয়টি খ্রিস্টধর্মের প্রতি বিপদের উত্স হয়ে দাঁড়িয়েছে।”