খ্রিস্টানরা এই ‘ওল্ড টেস্টামেন্টে’ বেশ কয়েকটি অধ্যায় সংযোজন করেছেন যা হিব্রু বাইবেলে অনুপস্থিত। এই সংযোজনা কিন্তু বাস্তবে ইহুদি মতবাদে তেমন কোন পরিবর্তন ঘটিয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। কেননা, ইহুদিরা নিজস্ব হিব্রু বাইবেলের পরে আর কোনো ধর্মগ্রন্থ অবতীর্ণ হওয়ার কথা অস্বীকার করেন। হিব্রু বাইবেল যেমনটি ছিল তেমনইভাবে তাকে গ্রহণ করা হলেও এরসঙ্গে খ্রিস্টানরা আরও কিছু নতুন অধ্যায় সংযোজন করেছেন। যদিও খ্রিস্টানরা যীশুর ধর্মপ্রচারের সাথে পরিচিত সবগুলো রচনাকে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করেননি। যীশুর জীবনী ও শিক্ষা-সংক্রান্ত পুস্তকের সংখ্যা কম ছিল না, তবুও নিজেদের ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গির্জার পুরোহিত-অধিকারীরা এসব থেকে যাচাই-বাছাই ও কাট-ছাঁট করে শুধু কয়েকটি রচনাকে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা দিয়েছেন। এভাবে, কিছুসংখ্যক রচনা বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে স্থান পেয়েছে। এরমধ্যে প্রামাণ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বলে পরিচিত চারটি গসপেল বা সুসমাচার। খ্রিস্টানরাও যীশু এবং তাঁর প্রেরিতদের পর আর কোনো প্রত্যাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তাই কোরআন তাদের কাছে বাতিল বলে গণ্য।
যীশুখ্রিস্টের ছশ বছর পর কোরআনের বাণীসমূহ অবতীর্ণ হয়, তাওরাত ও গসপেলের (ইঞ্জিল) বহু তথ্য ও পরিসংখ্যানের উল্লেখ ছাড়াও কোরআনে তাওরাত ও ইঞ্জিলের বহুল উদ্ধৃতি বিদ্যমান। কোরআন : ৪ : ১৩৬-এর মাধ্যমে ইতিপূর্বেকার সবগুলো আসমানী কিতাবের উপর বিশ্বাস স্থাপনের জন্য মুসলমানদের প্রতি নির্দেশ রয়েছে। তাছাড়াও, কোরআন অন্যান্য পয়গম্বর যেমনঃ যীশু বা হযরত ঈসা, হযরত মুসা ও তার পরবর্তী নবীদের এবং তাঁদের ওপর অবতীর্ণ হওয়া আল্লাহর বাণী সম্পর্কে সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। বিশেষ এক মর্যাদা দেয়া হয়েছে যীশু বা হযরত ঈসা (আঃ)-কে। বাইবেলের মতো কোরআনও তাঁর জন্মকে অতি-প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছে। কোরআনে যীশুমাতা মেরী বা হযরত মরিয়ম বিশেষ মর্যাদার আসনে আসীন। এমনকি কোরআনের ১৯নং সূরার নামকরণ করা হয়েছে যীমাতার নামানুসারে ‘মরিয়ম’।
সাধারণভাবে পূর্ববর্ণিত তথ্যসমূহ পাশ্চাত্যের লোকজনের অজানা। যদিও, তাই বলে বিস্ময়ের কিছু নেই, পাশ্চাত্য জগতে পুরুষানুক্রমে এমনভাবে এই শিক্ষাই দিয়ে আসা হচ্ছে। এক্ষেত্রে, তাঁদের অন্যতম প্রচারণা ইসলাম ধর্ম সম্পূর্ণভাবে একজন মানুষের সৃষ্টি এবং এই ধর্মের প্রবর্তনায় গড বা বিধাতার (খ্রিস্টীয় অর্থে) কোনো ভূমিকা নেই।
এখন বহু ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ইসলামের দার্শনিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে আগ্রহী হলেও তারা কখনো ইসলামের ওহী বা প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত বাণী-সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধানের তেমন কোনো আগ্রহ অনুভব করেননি। অথচ, তা করা তাদের উচিত।
ড. মরিস বুকাইলি বলেন, “যখন আমি বাইবেল ও কোরআনের তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণের জন্য খ্রিস্টান মহলের সাথে মত বিনিময়ের চেষ্টা চালিয়েছিলাম, তখন এই অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, মুসলমানদের কী ঘৃণার চোখেই না দেখে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীগণ।”
ড. মরিস বুকাইলি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁরা চিরাচরিত পদ্ধতিতেই কোরআনের প্রতি অনীহা প্রকাশ করেছেন। বিভিন্নবিষয়ে কোরআনের যে বক্তব্য, তা গ্রহণ করা তো দূরের কথা, এতদসংক্রান্ত কোনো বিষয়ে কোরআনের প্রতি সামান্য আকার-ইঙ্গিতও তারা আমলে নিতে রাজি হননি। কোরআনের কোনো উদ্ধৃতি তাঁদের কাছে দেয়া যেন শয়তানের বরাত দিয়ে কথা বলার সমান।
যাহোক, এখন খ্রিস্টান-জগতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ-বিষয়ে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ভ্যাটিক্যানের নন-ক্রিশ্চিয়ান অ্যাফেয়ার্স দফতর থেকে দ্বিতীয় ভ্যাটিক্যান কাউন্সিলের পর একটি তথ্যমূলক পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এর ফরাসি নামের বাংলা হচ্ছে ‘মুসলিম-খ্রিস্টান আলাপ আলোচনায় দিক-নির্দেশিকা’। ১৯৭০ সনে ফরাসি ভাষায় এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় রোমের “আনকোরা” নামের এক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে।
এই পুস্তকে মুসলমানদের ব্যাপারে ভ্যাটিক্যানের দৃষ্টিভঙ্গি যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে তার পরিচয় পাওয়া যায়। কারণ, এই পুস্তকে ইসলাম সম্পর্কে খ্রিস্টানদের প্রতি অতীত থেকে পাওয়া যাবতীয় বাতিল ধারণা ও কুসংস্কার এবং বিদ্বেষপ্রসূত বিকৃত মতামত পরিহারের জন্য বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ভ্যাটিক্যান থেকে সম্প্রচারিত এই দলিলে স্বীকৃত হয়েছে:
“অতীতে মুসলমানদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে এবং সেজন্য খ্রিস্টবাদী শিক্ষায় শিক্ষিত পাশ্চাত্য সমাজই দায়ী।
তাছাড়া, খ্রিস্টানদের মধ্যে যে-সব ভুল ধারণা রয়েছে মুসলমানদের অদৃষ্টবাদ, ইসলামিক বিধি-বিধান, তাঁদের রক্ষণশীলতা সম্পর্কে সে সব নিয়েও এই বইয়ে সমালোচনা করা হয়েছে। এই পুস্তকে স্রষ্টার একত্বের ভিত্তিতে ঐক্য গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব আরোপসহ তথ্য পরিবেশিত হয়েছে যে, ১৯৬৯ সনের মার্চ মাসে কার্ডিনাল কোয়েনিং এক সরকারি বৈঠকে যোগদানের জন্য কায়রো শহরে গিয়ে আল আজহার মুসলিম ইউনিভার্সিটির জামে মসজিদে এই ঐক্য গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, তাঁর সেই আহবানে শ্রোতারা অবাক হয়ে গিয়েছিল। এই পুস্তকে এও বলা হয়েছে যে, ১৯৬৭ সনে ভ্যাটিক্যান দফতর থেকে রমজান শেষে যথাযথ ধর্মীয় গুরুত্ব সহকারে মুসলমানদের প্রতি পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের জন্য খ্রিস্টানদের প্রতি আহবান জানানো হয়েছিল।