“প্রভু, প্রথমে আমার পিতাকে কবর দিয়ে আসতে অনুমতি দিন। কিন্তু যীশু তাঁকে বললেন, আমার অনুসরণ কর; মৃতেরাই নিজেদের মৃতদের কবর দিক” (মথি, ৮: ২১-২২)।
প্রকৃত মৃতদের দ্বারা অন্য মৃত ব্যক্তিদের কবর দেয়া কখনও সম্ভব নয়। কেবল আত্মিক মৃতদের দ্বারাই তা সম্ভব। এমন আত্মিক মৃতকে প্রত্যেক নবীই জীবিত করতে পারতেন। যেমন–পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে,
“হে বিশ্বাসীরা! আল্লাহ এবং রসুলের আহবানে সাড়া দাও, যখন তিনি আহবান করেন তোমাদেরকে জীবিত করার জন্যে। (৮: ২৫)।
প্রকৃতকথা হলো, যীশুসহ আরও অনেকেই এসব কাজ করতে সক্ষম ছিলেন এবং ভবিষ্যতেও সক্ষম হবেন বলে খোদ বাইবেলেই বলা হয়েছে, যেমন–এলিয় এক মহিলার মৃত পুত্রকে জীবিত করে তুলেছিলেন (১ রাজাবলী, ১৭ : ২১-২২)। ইলীশায় নামান নামীয় কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্যদান করেছিলেন (২ রাজাবলী, ৫: ১-১৪)। অন্যেরাও ভূত ছাড়াতে সক্ষম (মার্ক, ১৬ : ১৭) যীশুর ন্যায় অদ্ভুত কাজ আরও অনেকেই করতে পারে (মথি, ২১ : ২১) এমনকি যীশু থেকেও বড় কাজ অন্যেরা করতে পারে (যোহন, ১৪ : ২১)।
যীশুর খোদাত্বের আরও কিছু অসারতা
খ্রিস্টধর্ম প্রচারকেরা যীশুর খোদাত্বের প্রমাণস্বরূপ আরও যেসব দলিল পেশ করেন, সেগুলোর অসারতা বাইবেল থেকে উদ্ধৃত করা হল :
পাপমোচন করার ক্ষমতা খোদাত্বের প্রমাণ নয়, অন্যেরাও পাপ মোচন করতে পারে (যোহন, ২০ : ২৩)। যীশু পিতায় এবং পিতা যীশুতে থাকা খোদাত্বের প্রমাণ নয়, কারণ অন্য লোকেরাও যীশুর ন্যায় খোদাতে থাকতে পারেন (যোহন, ১৭ : ২১)। যীশু ও খোদা এক, এ বাক্যও খোদাত্বের প্রমাণ নয়। অন্যের জন্যও এ বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে। (যোহন, ১৭:১১; আদি, ১: ২৭)। এছাড়া, যীশু সর্বদাই খোদাত্বের কথা অস্বীকার করেছেন, বরং তিনি নিজেকে খোদার দাস, প্রেরিত, ভাববাদী, মনুষ্য-পুত্র এবং পবিত্র ব্যক্তি বলে পরিচয় দিয়েছেন। এ সম্বন্ধে নিতে কয়েকটি প্রমাণ উপস্থাপন করা হল :
যীশু মানুষ (মথি, ৯ : ৮)। যীশু মনুষ্য-পুত্র (মথি, ১২: ৮; ১৩ : ৩৭)। যীশু খোদার প্রেরিত (মথি, ১০ : ৪০; যোহন, ৭ : ১৬ ১৭ : ৩)। যীশু ভাববাদী (মথি, ১৩ : ৫৭; ২১:১১)। যীশু পবিত্র ব্যক্তি (যোহন, ৬ : ৬৯)। যীশু খোদার দাস (প্রেরিত, ৩ : ১৩; ৪ : ২৭)। যীশু মানুষ ছিলেন, এজন্য খোদার নিকট প্রার্থনা করতেন (মথি, ২৭ : ৪৬)। যীশু দুর্বল মানুষ ছিলেন, এজন্য মৃত্যুভয়ে ভীত ছিলেন (মার্ক, ১৪ : ৩৬)। যীশু খোদা নন, এ জন্য তিনি মানুষের পাপের বিচার করতে পারেন না (যোহন, ১২ : ৪৭-৫০)। যীশু নিজেকে খোদা থেকে পৃথক দেখিয়েছেন; যেমন–তিনি বলেন, “খোদাতে বিশ্বাস কর, আমাতেও বিশ্বাস কর” (যোহন, ১৪:১)।
ত্রিত্ববাদ ও খোদার পুত্রত্বের ইতিহাস
খ্রিস্টের দু’হাজার বছর পূর্বে ব্যবিলন অঞ্চলে ‘মরদুক’ বলে এক দেবতার কাহিনী পাওয়া যায়। ‘মরদুক’ ছিলেন ব্যবিলনবাসী সর্বেশ্বরবাদীদের সূর্য দেবতা। খ্রিস্টপূর্ব ১৯৫০ অব্দে ব্যবিলনের রাজনৈতিক প্রাধান্য লাভের পর মরদুক প্রাচ্যের প্রধানতম সেমাইটদের দেবতার মর্যাদা লাভে সমর্থ হয়। খালদীন ও ব্যবিলনবাসীরা মরদুককে খোদার প্রিয় পুত্র মনে করত। তারা এই দেবতার প্রতি যেসকল গুণাবলী আরোপ করেছিল, যীশুর প্রতিও খ্রিস্টানরা সেই সমস্ত গুণাবলী আরোপ করেছিল বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। আরব, ইরান, সিরিয়া এবং মিশরের মুশরেকরা বৌদ্ধমত ও সূর্য পূজার দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিল এবং তারাই যীশুর প্রতিও ঐ সকল গুণাবলী আরোপ করেছিল। এদিক থেকেও খ্রিস্টানরা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিল। যীশু নিজেকে একজন ‘মানুষ’-এর অতিরিক্ত করে প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হননি। পৌত্তলিকরা এবং অগ্নি-পূজকরাই তাঁকে খোদার পুত্র বলে আখ্যায়িত করেছে। ফলে, মুসা (আঃ) এবং বনি ইস্রায়ীল পয়গম্বরদের দ্বারা প্রবর্তিত ধর্মের শিক্ষাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তাকে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। তার অব্যবহিত পরেই তার দেয়া শিক্ষাও জটিল হয়ে ওঠে, যারফলে জন্ম নেয় খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদ। যা অজস্র রক্তপাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
যীশুর উপরে এ ধরনের মিথ্যা কল্পনারোপের ব্যাপারে ‘মিথরা’ মতবাদই খ্রিস্টানদেরকে সর্বাপেক্ষা বেশি বিপথগামী করেছে বলে মনে হয়। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচশ’ অব্দে পারস্যে এই মতবাদ প্রচলিত ছিল। মিথরার জন্ম হয় একটি পর্বতগুহায়। জন্মের তারিখটি ২৫শে ডিসেম্বর বলে মনে করা হয়। একজন কুমারীই তাঁকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। তাঁর বারোজন সাগরেদ ছিলেন। তিনি বহু দেশদর্শী ছিলেন। মানবতার সেবায় তার জীবন উৎসর্গীত হয়েছিল, তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন, কবরস্থ হয়েছিলন, আবার বেঁচেও উঠেছিলেন। তাঁর পুনরুত্থানকে বিপুলভাবে অভিনন্দিতও করা হয়েছিল। এ সকল কথাই মিথরা সম্পর্কে প্রচলিত বিশ্বাস এবং তা যীশু সম্পর্কে তৈরি খ্রিস্টানদের কাহিনীর সাথে হুবহু মিলে যায়। আশ্চর্যের বিষয়, সাধু পৌল মহাশয়ই নাকি এ-সকল ক্রিয়াকাণ্ডের মূলনায়ক। তার অপব্যাখ্যাই যীশুখ্রিস্টকে এত বিকৃতরূপে পৃথিবীর সামনে উপস্থাপিত করেছে। পক্ষান্তরে, সাধু পিতর, যিনি যীশুখ্রিস্টের একান্ত শিষ্য ছিলেন, তার দ্বারা এসবকিছুই হয়নি।