পূর্বোক্ত ব্যাখ্যার আলোকে এবং কাদা-মাটির রূপক অর্থ সম্মুখে রেখে ‘তোমাদের জন্য কাদা-মাটি থেকে আমি পাখির অবস্থার অনুরূপ সৃষ্টি করব, অতঃপর তার মধ্যে আমি নবজীবন) ফুৎকার করব, ফলে তা আল্লাহর আদেশে উড্ডয়নশীল হয়ে যাবে ইত্যাদি কথার মর্ম বুঝার চেষ্টা করলে, তার তাৎপর্য দাঁড়াবে এই যে, সাধারণ অনভিজাত লোক, যাদেরমধ্যে উন্নতি ও জাগরণের শক্তি রয়েছে, তারা যদি ঈসা (আঃ)-এর সংস্পর্শে আসে ও তার বাণী গ্রহণ করে জীবনযাপন করে তবে তাদের জীবনে আমূল পরিবর্তন এসে যাবে। ধূলি ধূসরিত, সংসারাসক্ত, বস্তু-কেন্দ্রিক জীবনকে জলাঞ্জলি দিয়ে, তারা অধ্যাত্মিক আকাশের উচ্চমার্গে পাখির মত বিচরণ করতে সমর্থ হবে এবং প্রকৃতপক্ষে তাই ঘটেছিল। ঘৃণিত, অবহেলিত গালিলীর জেলেরা, তাদের প্রভু ও গুরুর উপদেশ ও উদাহরণ অনুসরণের মাধ্যমে, পাখিরই মত উচ্চমার্গে আরোহণ করে, বণী ইস্রায়ীল জাতির মধ্যে আল্লাহর বাণী প্রচারের তৌফিক লাভ করেছিল। অন্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিদের রোগমুক্তির বা উপশমদানের সম্বন্ধে বলা যায়, এ ধরনের রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদেরকে বণী-ইস্রায়ীল জাতি অপবিত্র ও নোংরা জানে, এদেরকে সমাজের সংশ্রব থেকে দূরে রাখত; সমাজে ঘেঁষতে দিত না। … … ‘আমি মুক্ত করে দিব কথাটির তাৎপর্য এই যে, এসব রোগাক্রান্ত লোকেরা আইনগত ও সমাজগতভাবে, অবহেলিতবস্থায় বহু বঞ্চনা ও অসুবিধার মধ্যে ঘৃণিত পরিবেশে বাস করত। ঈসা (আঃ) এসে তাদেরকে সেবা-যত্ন করার তাগিদ দিয়ে, সমাজে তাদেরকে স্থান দান করে, তাদেরকে দুর্বিসহ জীবন থেকে মুক্ত করেছিলেন। এও হতে পারে যে, ঈসা (আঃ) এসব রোগীকে সুস্থ করতেন। … … আল্লাহর নবীগণ আধ্যাত্মিক চিকিৎসকবিশেষ; তারা আধ্যাত্মিক অন্ধদেরকে চক্ষুদান করেন, বধিরকে শ্রবণশক্তি দান করেন, আধ্যাত্মিক মৃতদেরকে জীবনদান করেন (মথি, ১৩ : ১৫)।…… আমি মৃতের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করব’ বাক্যটির অর্থ এটা নয় যে, ঈসা (আঃ) মৃত ব্যক্তিকে সত্যিই জীবিত করেছিলেন। যারা প্রকৃতই মরে যায়, তারা পৃথিবীর বুকে কখনও পুনরুজ্জীবিত হয় না। এ ধরনের বিশ্বাস কোরআনের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত (২ : ২৯; ২৩:১০০-১০১; ২১ : ৯৬; ৩৯ : ৫১-৬০; ৪০ : ১২; ৪৫ : ২৭)।… … প্রকৃতপক্ষে, আধ্যাত্মিক পরিভাষা মতে, নবীগণ তাঁদের অনুসারীদের জীবনে যে বৈপ্লবিক ও অসাধারণ মহাপরিবর্তন আনেন, তাকেই বলা হয় মৃতকে জীবিত করা।… … এবং তোমরা কি খাবে এবং তোমাদের ঘরে কি সঞ্চয় করবে বাক্যাংশটির সামগ্রিক অর্থ দাঁড়ায় : ঈসা (আঃ) তাঁর শিষ্যদেরকে শিক্ষা দিবেন, দিনযাপনের জন্য তারা কি পরিমাণ খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে খরচ করবে এবং কি পরিমাণ তারা বাঁচাবে অর্থাৎ, পরকালে পাবার জন্য খরচ করবে। অন্যকথায়, ঈসা (আঃ) তাদেরকে বললেন, তারা ন্যায়ভাবে যা উপার্জন করবে, তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করবে, এবং অবশিষ্ট অর্থ আল্লাহর পথে খরচ করবে। আর আগামীদিনের কথা আল্লাহ্’র উপর ছেড়ে দিবে (তুলিতব্য, মথি, ৬ : ২৫- ২৬)।”
মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ সাহেব আলোচ্য আয়াতের বিস্তারিত আলোচনার পর আয়াতের ভাবার্থে বলেন,
“হযরত ঈসা (আঃ) যা যীশুখ্রিস্ট আল্লাহর বাণী প্রাপ্ত হয়ে প্রথমেই ঘোষণা করেছিলেন যে, হে ইস্রায়ীলকুল, তোমাদেরকে প্রকৃতিগত মূল উপাদান (তীন) হতে আবার তোমাদেরকে পূর্বের ন্যায় একটি মহাজাতিরূপে গঠনের চেষ্টা করব, এজন্য প্রথমে গঠন করব–জাতির কাবুদ মাত্রকে। তারপর সে কালবুদের মধ্যে স্বর্গীয় প্রেরণা প্রবেশ করিয়ে দিয়ে জানা সমাজকে দিব্য দৃষ্টিদানে–নানা জঘন্য ব্যভিচার ব্যধি-কলুষিত জাতিকে আল্লাহর অনুমতিক্রমে এক মুক্ত জীবন্ত ও উধ্বগতি উন্নতমুখী জাতিতে পরিণত করে দেব। এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে–মূর্খতা ও পাপাচারে যাদের জ্ঞান ও বিবেক মরে গেছে, যাদের হৃদয় সত্যের অনুভূতি শক্তি থেকে বঞ্চিত ও অসাড় হয়ে পড়েছে, তাদের মধ্যে মুক্ত জ্ঞানের ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার স্বর্গীয় প্রেরণা জাগ্রত করে আবার তাদেরকে ধর্মের হিসেবে জীবন্ত করে তুলব। আর পার্থিব জীবনের ভোগ ও পারলৌকিক জীবনের সঞ্চয় কি হবে তাও তোমাদের জ্ঞাত করব। এই মিশন ও এই সাধনা নিয়েই আমি তোমাদের প্রভুর সন্নিধান থেকে তোমাদের সমীপে প্রেরিত হয়েছি।”
অবশেষে, খ্রিস্টান প্রচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় যে, যীশু যেসব জুরা, মৃত্যু এবং ব্যধিগ্রস্ত লোককে আরোগ্য দান করেছিলেন, তারা কেউই প্রকৃতপক্ষে দৈহিকভাবে রোগাক্রান্ত বা মৃত ছিল না; বরং পাপের ফলে আত্মিক দিকদিয়ে মৃত বা ব্যধিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল বলে খোদ বাইবেলেই প্রমাণ রয়েছে, যেমন যীশু এক পক্ষাঘাতকে আরোগ্য দান করে বললেন, “তোমার পাপ ক্ষমা হলো।” (মথি, ৯ : ২)। এখানে পাপমুক্ত হওয়ায় যে রোগ আরোগ্য হয়ে গেল তা আত্মিক ব্যাধি ছাড়া অন্য কিছু নয়। অন্য এক রোগীকে সুস্থ করে বললেন, “দেখ তুমি সুস্থ হলে, আর পাপ করো না।” (যোহন, ৫: ১৪)। অর্থাৎ, পুনরায় পাপ করলে আবার অসুস্থ হয়ে পড়তে হবে। এস্থলেও আত্মিক দিকদিয়ে সুস্থ হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। আত্মিক মৃত সম্বন্ধে শিষ্যদের মধ্যে আর একজন তাঁকে বললেন,