“হে মানবমণ্ডলী! একটি উপমা দেওয়া হচ্ছে, তোমরা তা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর নিশ্চয় তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে ডাকছ, তারা কখনও একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এই উদ্দেশ্যে তারা সকলে একত্র হলেও। এবং মাছি যদি তাদের নিকট থেকে কোন কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায় তারা তাও তার নিকট থেকে উদ্ধার করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে অন্বেষক ও অস্পেষিত উভয়ই কত দুর্বল” (২২ : ৭৪)।
এই আয়াত দুটো থেকে জানা যায় যে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে তার আসনে বসানো হয়েছে (১) সৃষ্টির অধিকার তাদের নেই (২) কারও মৃত্যু ঘটানোর অধিকার তাদের নেই। (৩) কাউকে জীবনদানের অধিকার তাদের নেই। (৪) কোন মৃতকে জীবিত করার শক্তি তাদের নেই।
সুতরাং, ভ্রষ্ট মানব-সমাজ এ পর্যন্ত যাদেরকে আল্লাহর অংশীদাররূপে গ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে অন্যতম যীশুখ্রিস্ট যে ঐ গুণ চতুষ্টয়ের অধিকারী ছিলেন না, তা স্পষ্টভাবে জানা যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, পবিত্র কোরআন ও হাদীস থেকে জানা যায় যে, মানুষ একবার মরে যাবার পর কিয়ামত পর্যন্ত তার পুনর্জীবিত হওয়া সম্ভব নয়। যেমন–পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন :
“এবং প্রত্যেক জনপদের জন্য, যাকে আমরা ধ্বংস করেছি তার সম্পর্কে হারাম (অলঙ্ঘনীয় বিধান) করা হয়েছে যে, তার অধিবাসীবৃন্দ পুনরায় কখনও ফিরে আসবে না” (২১ : ৯৬)।
হাদিসে আছে, আল্লাহতায়ালা শহীদদেরকে তাদের প্রার্থনা পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রার্থনা করতে উদ্বুদ্ধ করছেন : “হে আমার বান্দা, আমার কাছে প্রার্থনা কর, আমি তোমাকে তা দান করব।’ শহীদরা তখন বলে : আমাদের কোনই অভাব নেই। আল্লাহর পক্ষ থেকে বারবার ঐরকম প্রশ্ন হওয়ার এবং তাদের পক্ষ থেকে ঐধরনের উত্তর দেয়ার পরও যখন আল্লাহ ঐরূপ জিজ্ঞেস করেন, শহীদরা তখন বলেন, হে প্রভু, আমাদের একমাত্র আকাঙ্গ আপনি আবার আমাদেরকে জীবিত করে দুনিয়ায় পাঠান, আবার আমরা আপনার নামে জেহাদ করি এবং শহীদরূপে নিহত হই। তখন আল্লাহ বলেন : ‘আমার অল্য নির্দেশ : মৃতেরা আর দুনিয়ায় ফিরবে না।’ (মুসলিম শরীফ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ প্রভৃতি)।
প্রকৃতপক্ষে, যীর মূল শিক্ষা থেকে খ্রিস্টান সমাজ কতদূর ঋলিত হয়েছে, নাজরান ডেপুটেশনকে তা বুঝিয়ে দেয়ার জন্যই যীশুর নিজমুখের উক্তি ৩: ৫০ আয়াতে তারই ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছে। এরমধ্যে যে গূঢ় তত্ত্ব নিহিত আছে, তা জানতে যীশুর জীবনচরিতের আশ্রয় নিতে হবে। তাঁর জীবনেতিহাস রচয়িতারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, যেকোন কারণেই হোক, যীশু জনসাধারণের মধ্যে তার ধর্মমত প্রচার করতেন রূপকভাবে (Allegorical) উপমা উদাহরণের মাধ্যমে।
মথি বলেছেন :
“তখন তিনি উপমাদ্বারা তাদের নিকট অনেক কথা বললেন (১৩ : ৩) পরে শিষ্যেরা তাঁর কাছে এসে তাঁকে বললেন, আপনি কি কারণে উপমাঘারা এদের নিকট কথা বলছেন? তিনি উত্তরে তাঁদের বললেন, স্বর্গরাজ্যের নিগূঢ় তত্ত্বগুলো তোমাদের জানতে দেয়া হয়েছে, কিন্তু তাদের দেয়া হয়নি। কারণ, যার আছে, তাকে দেয়া হবে, আর তার উপচে পড়বে; কিন্তু যার নেই, তার যা আছে তাও তার কাছ থেকে নেয়া হবে। এজন্য, আমি উপমা দ্বারা তাদের নিকট কথা বলি, কারণ তারা দেখেও-দেখে-না আর শুনেও-শুনে-না এবং বুঝেও-বুঝে-না” (১৩ : ১০-১৩)।
মার্ক বলছেন :
“তিনি উপমা দ্বারা তাদের অনেক বিষয় শিক্ষা দিলেন (৪ : ৩) পরে যখন তিনি একাকী ছিলেন তখন তাঁর সঙ্গীরা সেই বারোজন শিষ্যকে নিয়ে তাঁকে উপমা কয়টির বিষয় জিজ্ঞেস করলেন। তিনি তাঁদের বললেন, খোদার রাজ্যের নিগঢ়-তত্ত তোমাদের জানতে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যারা বাইরে রয়েছে, তাদের জন্য সমস্ত কিছুই উপমা দিয়ে বলা হয়”। যেন তারা যদিও দেখে তবুও প্রত্যক্ষ না করে, যদিও শুনে তথাপি না বুঝে, পাছে তারা ফিরে আসে ও তাদের ক্ষমা করা হয়।‘ পরে তিনি তাদের বললেন, তোমরা এই উপমাটি যখন বুঝতে পারলে না, তখন অন্যান্যগুলোর অর্থ কি করে বুঝবে?” (৪:১০ : ১৩)।
পূর্বোক্ত বর্ণনা থেকে জানা যাচ্ছে যে, যীশু জনসাধারণের মধ্যে রূপক ভাষায় উপমা উদাহরণের মধ্যদিয়ে ধর্মকথা প্রচার করতেন, যার মর্ম তারা কিছুই বুঝতে পারত না। এমনকি, তার অন্তরঙ্গ শিষ্য-সহচরদের পক্ষেও অনেক সময় সে সবের মর্ম গ্রহণ করা ছিল অসম্ভব। এজন্য, বাড়ি গিয়ে তিনি তার মর্ম শিষ্যদেরকে বুঝিয়ে দিতেন।
অতএব, যীশু কি বলেছেন, না বলেছেন তার প্রকৃত মর্ম যখন তৎকালীন জনসাধারণ এমন কি শিষ্য-সহচররা পর্যন্ত বুঝতে পারতেন না, বর্তমান খ্রিস্টানদের তো বুঝার প্রশ্নই ওঠে না; অধিকন্তু যীশুর কাছে জিজ্ঞেস করার কোন সুযোগ-সুবিধা যখন এখন নেই তখন ৩ : ৫০ আয়াতের অবোধ্য উক্তি নিয়ে যীশুখ্রিস্টের অতিমানুষী বা খোদায়ী-সরূপের ভিত্তি খোঁজা খ্রিস্টান প্রচারকদের সঙ্গত নয়।
যুক্তরাজ্য থেকে ১৯৮৮ সালে Islam International Publications Limited কর্তৃক প্রকাশিত The Holy Quran, Vol. 2, p-401-404-এ আলোচ্য আয়াতের টীকায় বলা হয়েছে :
“বাইবেলের কোথাও উল্লেখ নেই যে, ঈসা (আঃ) মোজেযা প্রদর্শন করার জন্য পাখি সৃষ্টি করে আকাশে উড়িয়েছেন। সত্যি সত্যি যদি ঈসা (আঃ) পাখি বানিয়ে উড়িয়ে থাকতেন, তবে বাইবেলে তা কিভাবে ও কেন অনুল্লিখিত থাকল? আল্লাহর কোন নবী পূর্বে এ ধরনের ঐশী নিদর্শন দেখাননি। অথচ, বাইবেল এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নীরব। বাইবেলে এই মহা-নিদর্শনের উল্লেখ থাকলে, সকল নবীর উপর ঈসা (আঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন হত এবং পরবর্তীকালের খ্রিস্টানরা ঈসার প্রতি যে ঈশ্বরত্ব আরোপ করেছে, তাও কিছুটা সমর্থন লাভ করত। খালক’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়–মাপ বা ওজন করা, পরিমাপ ঠিক করা, নক্সা তৈরি করা, আকৃতি দেয়া, পোশাক তৈরি করা, সৃষ্টি করা ইত্যাদি। সৃষ্টি করা অর্থে ‘পালক’ শব্দটি কোরআনের কোথাও আল্লাহর কাজ ছাড়া অন্য কারও কাজ বলে স্বীকৃতি পায়নি; আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও প্রতি এই গুণটি কোরআনের কোথাও আরোপিত হয়নি (১৩ : ১৭; ১৬ : ২১; ২২: ৭৪; ২৫ : ৪; ৩১:১১-১২, ৩৫ : ৪১ এবং ৪৬ : ৫)।