যীশুকে বাইবেলে খোদার পুত্র কেন বলা হয়েছে সে বিষয়ে একটি উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক ও হিব্রুতে ‘খোদার পুত্র’ স্থলে ‘বেনে এলোহীম’ বলা হয়েছে, এর অর্থ অত্যন্ত প্রিয়, রাজা, স্বর্গীয় দূত, ‘খোদার সেবক’ (দেখুন Gesenius কৃত Hebrew And English Lexican, English Translation–J. W. Gibbs, page-34)। এছাড়া, খোদার পুত্র বা ঈশ্বরপুত্র শব্দটি একটি সম্মানসূচক রাজকীয় পদবী। রোমান সম্রাট এই উপাধিটি (ডিভি/ফিলিউস) ধারণ করতেন। কিন্তু, যীশু এসবে খুবই বিরক্ত হতেন এবং বারবার লোকদেরকে এ বিষয়ে সাবধান করতেন যদিও নিবৃত্ত করতে পারতেন না।
বার্ণাবার উত্তর:
বার্ণাবা, যিনি পৌলের সহপ্রচারক ও বন্দী জীবনের সঙ্গী তিনি তাঁর সুসমাচারে যীশুর একত্ববাদ প্রচারের কথা উল্লেখ করে লিখেন, “যারা যীশুকে খোদার পুত্ররূপে পূজা করে তাদের উপর মহাত্মা যীশু অভিসম্পাত বর্ষণ করেছেন। যেমন, ‘Crused be every One who shall insert into my Saying that I am the Son of the God’ (Chapter-53)। বার্ণাবা তাঁর সুসমাচারের শেষ–২২২ অধ্যায়ে লিখেন, Certain evil men, …. preached, and yet preach, that Jesus is the Son of God, among whom is Paul decived, অর্থাৎ কয়েকজন অপবিত্র লোক … প্রচার করে থাকে যে, যীশু খোদার পুত্র, আর এসব প্রচারকদের মধ্যে প্রতারিত পৌলও একজন।
যীশুর অলৌকিক কীর্তিকলাপ খোদাত্বের প্রমাণ?
খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকরা যীশুর খোদাত্বের প্রমাণস্বরূপ বলে থাকেন যে, যীশু নানাপ্রকার অলৌকিক কাজ করেছেন, যা খোদা ব্যতীত অন্য কারও দ্বারা অসম্ভব। যেমন : মৃতকে জীবিত করা, অন্ধকে দৃষ্টিদান করা কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্যদান প্রভৃতি। এর স্বপক্ষে তারা পবিত্র কোরআনের ৩: ৫০ আয়াতের উল্লেখ করে বলে থাকেন যে, কোরআনেও যীশুর খোদাত্ব স্বীকার করা হয়েছে এবং কোরআনের কোন কোন তাফসীরকারও যীশু কর্তৃক “মৃত্তিকার দ্বারা পাখির আকৃতি গঠনপূর্বক ফুস্কার প্রদান করে তাকে জীবিত পাখিতে পরিণত করা, মৃতকে জীবিত করা, জন্মান্ধকে দৃষ্টিশক্তি প্রদান করা এবং কুষ্ঠ-রোগীকে স্পর্শমাত্র আরোগ্য করা …. এতদ্ভিন্ন সমবেত লোকদের খাদ্য-পানীয় এবং সংগৃহীত দ্রব্যাদি সম্বন্ধেও নানারূপ বিস্ময়কর সংবাদ” দেয়া সম্বন্ধে বিশ্বাস ও সংস্কারের পূর্ণ সমর্থন করেছেন।
মাওলানা মোহাম্মদ আলী হাসান বলেন, “বাইবেলে হযরত ঈসা কর্তৃক জন্মান্ধকে দৃষ্টিদান, কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য এবং মৃতকে জীবিত করার প্রথা লিপিবদ্ধ রয়েছে; কিন্তু মৃন্ময় পক্ষীকে সজীব করার কথা উল্লিখিত হয়নি। ইহুদীরা ঐসব কথায় সম্পূর্ণ অবিশ্বাসী। খ্রিস্টানরাও বাইবেলে যা লিখিত আছে, তদ্ব্যতীত অন্যকথার প্রতি অবিশ্বাসী। আধুনিক কোন কোন তাফসীরকার হযরত ঈসার অলৌকিক নিদর্শন সম্বন্ধে পবিত্র কোরআন ও বাইবেলে যে-সব উক্তি আছে, তার সবগুলোকেই রূপক বর্ণনা বলে অভিহিত করছেন তাঁরা বলেন, “আল্লাহ ব্যতীত অপরের পক্ষে মৃতকে জীবন দান করা, কোন নতুন জীব সৃষ্টি করা কিংবা প্রাকৃতিক শক্তিকে স্বীয় আজ্ঞাধীন করা সম্পূর্ণ অসম্ভব”। তাদের মতে, মৃন্ময় পক্ষী-মূর্তিকে সজীব করার অর্থ তুচ্ছ মাটির মানুষকে আধ্যাত্মিক জীবন্ত-শক্তি প্রদান করা, মৃতকে জীবিত করার অর্থ অবনত ও পতিত জাতিকে উন্নত ও শক্তিশালী করা এবং অন্ধকে দৃষ্টিদান, খঞ্জকে চলৎশক্তি, রোগীকে আরোগ্য ও বধিরকে শ্রবণশক্তি দান করা (নতুন নিয়ম) প্রভৃতির অর্থ ধর্মহীনকে ধর্ম শিক্ষাদান, পথভ্রান্তকে পথ-প্রদর্শন, অজ্ঞানান্ধকে জ্ঞানের আলোক বিতরণ এবং নির্বোধ মুখদেরকে ধর্মজ্ঞান ও উপদেশ প্রদান প্রভৃতি। তঃ কবির, বয়জবী ও বাঃ কোঃ মঃ আঃ প্রভৃতি তুলিতব্য।” (তরজমা ও তাফসীর, ১ম খণ্ড, ১৭১-৭২ পৃষ্ঠা, ওসমানিয়া লাইব্রেরি, কলকাতা)।
পবিত্র কোরআনের ৩ : ৫০ আয়াতে বলা হয়েছে, ফেরেশতা কর্তৃক যীশু তাঁর স্বজাতীয়দের কাছে কি বলবেন, কি করবেন সেই ভাবী বিষয়গুলো যীশুর বিশেষ নিজস্ব ভাষায় মরিয়মের নিকট অভিব্যক্ত হয়েছে। যীশু বনী ইস্রায়ীলের নিকট রসূলরূপে প্রেরিত হয়ে বলেছিলেন :
“… আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি। আমি তোমাদের জন্য কাদা থেকে পাখির আকার সদৃশ সৃষ্টি করব; অতঃপর তাতে আমি ফুঙ্কার করব, ফলে তা আল্লাহর আদেশে উড্ডয়নশীল হবে এবং আমি আল্লাহর আদেশে অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে নিরাময় করব এবং মৃতদেরকে জীবনদান করব এবং তোমরা কি খাবে এবং তোমাদের ঘরে কি সঞ্চয় করবে সে বিষয়ে তোমাদেরকে আমি অবহিত করব। নিশ্চয় এর মধ্যে তোমাদের জন্য এক নিদর্শন রয়েছে যদি তোমরা মোমেন হও।”
এখানে আয়াতের বিভিন্ন অর্থবাচক শব্দগুলোকে সাধারণ অর্থে গ্রহণ করলে স্বীকৃত হয়, সৃষ্টি করার, মাটি দিয়ে পাখি তৈরি করার এবং মৃতদেরকে জীবিত করার শক্তি যীশুর ছিল এবং সে শক্তি নিশ্চয় তিনি প্রয়োগও করেছেন। কিন্তু কোরআনের নৈতিক শিক্ষার বিরুদ্ধে এমন তাৎপর্য গ্রহণ করা মোটেই সঙ্গত হবে না। কেননা, পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে:
“এবং তারা তাঁর পরিবর্তে এমন মা’বুদ গ্রহণ করেছে যারা কোন কিছু সৃষ্টি করে না বরং নিজেরাই সৃষ্ট, বস্তুতঃ তারা নিজেদের জন্যও না কোন উপকার এবং না কোন অপকার করার ক্ষমতা রাখে এবং না জীবন না মরণ এবং না পুনরুথানেরই তারা কোন ক্ষমতা রাখে।” (২৫ : ৪)।