“চিকিৎসাবিদগণ প্রাকৃতিক ‘পারথেনোজেনেসিস’ বা কোন পুরুষ সংসর্গ ছাড়াই শুধু নারীর দ্বারা সন্তান উৎপাদনের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ ধরনের উক্তিকে দ্বিধাহীনচিত্তে হাস্যম্পদ মনে হলেও জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে কতগুলো শর্তসাপেক্ষে এহেন সম্ভাবনাকে স্বীকার করতে হয়। ডক্টর টিমি এমন সম্ভাবনা সম্পর্কে বলেন, ‘আরহেনোব্লাস্টোমা” নামে পরিচিত (পুরুষ এবং বীর্যর জন্য গ্রীক শব্দ থেকে উদ্ভূত) একপ্রকার টিউমার নারীর নিজের মধ্যে কখনো কখনো উৎসৃষ্ট হয়, যার ফলে এমন ঘটে। এ টিউমারগুলো পুরুষ শুক্রাণু বা পুং-জননকোষ উৎপাদন করতে সক্ষম। স্বভাবতঃই যদি এই পুরুষ শুক্রকোষগুলো জীবন্ত ও তৎপর হয়ে নারীর ডিম্বকোষে অথবা ডিম্বের সংস্পর্শে আসে, তবেই গর্ভসঞ্চার হতে পারে। এমন ঘটনার প্রক্রিয়ায় যৌক্তিকতা রয়েছে … … ডক্টর টিমি বলেন, ইউরোপে এমন বিশটি প্রাথমিক ঘটনার বিবরণ পাওয়া গেছে, যাতে ‘আরহেনোব্লাস্টোমাই’ পুরুষ জননকোষ সৃষ্টি করেছে। আরহেনোরাস্টোমা এক ধরনের টিউমার, যাতে রাস্টোডারমিক কোষ থাকে। … এই কোষগুলোর গঠন-প্রক্রিয়া সৃজনশীল এবং যেকোন সময় বর্ধিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। কাজেই আরহেনোরাস্টোমা’য় অবস্থিত এই অপরিপক্ক কোষগুলো যে অণ্ডকোষ-উপাদান সৃষ্টি করতে পারে এবং পুরুষ জীবকোষও সৃষ্টি করতে পারে বৈজ্ঞানিক মতে, তা সম্ভব। … যদি ‘আরহেনোব্লাস্টোমা’ প্রক্রিয়ায় নারীদেহে জীবন্ত পুরুষ শুক্রকোষ সৃষ্ট হয়, তাহলে নারীদেহে এমনকি কুমারী গর্ভে সন্তান উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না। সুতরাং, এহেনবস্থায় নারীর নিজ দেহে একই অবস্থার সৃষ্টি হবে, যে অবস্থার সৃষ্টি হবে পুরুষ দেহ থেকে যদি জীবকোষ স্বাভাবিকভাবে অথবা চিকিৎসকের সাহায্যে নারীদেহে স্থানান্তরিত হয়।” –(আমেরিকান মেডিকেল জার্নাল)।
পত্রিকাটিতে পিতৃবিহীন সন্তান-জন্মের কয়েকটি ঘটনাও উল্লিখিত আছে :
“উত্তম নৈতিক চরিত্রের এক যুবতী গর্ভধারণ করেছিল অথচ এই উৎস সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্রও জ্ঞান ছিল না। …. পুরুষের সংস্পর্শবিহীন এক অবিবাহিতার গর্ভধারণের এমন এক ঘটনা রয়েছে যে, তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করার সকল প্রকারের প্রচেষ্টাকে সে যুক্তি প্রমাণ দ্বারা কৃতিত্বের সাথে ব্যর্থ করে দিয়েছে। সে বিনাপিতায় গর্ভবতী হয় এবং সুগঠিত সুদর্শন এক কন্যা-সন্তান প্রসব করে।”
সুতরাং, মরিয়ম কিভাবে যীশুকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন, উপরোকৃত তথ্যাদি থেকে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, আল্লাহ্তা’য়ালার কার্যকলাপ দুর্বোধ্য এবং তার শক্তিসমূহ অপরিসীম, যিনি সমগ্র বিশ্ব একটি ‘কুন’ (হও) শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন। তিনি পদার্থে এমন পরিবর্তন ঘটাতে পারেন, যার ফলে যা বাহ্যতঃ দুর্বোধ্য বলে মনে হলেও তার সমাধান পাওয়া যেতে পারে।
যাহোক, যীশুর বিনাপিতায় জন্মলাভের মধ্যে কোন বিশেষত্ব নেই, আর এজন্য তিনি খোদার পুত্র হতে পারেন না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, “সেইত তিনি, যিনি তোমাদের জরায়ুতে যেমন ইচ্ছা আকার দান করেন; তিনি ব্যতীত খোদা আর কেউ নেই–প্রবল প্রজ্ঞাময় তিনি” (৩ : ৫)। যীশু সম্বন্ধে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “ইন্না মাছালা ঈসা ইন্নাল্লাহি কামাছালি আদামা খালাকাহু মিন তুরাব (৩ : ৬০) অর্থাৎ আল্লাহর কাছে যীশুর জন্ম অস্বাভাবিক কিছু নয়–বরং আদামা বা অন্যান্য মানুষের জন্মের মতোই অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। তিনি যীশুসহ সকল মানুষকেই মাটি দিয়ে তৈরি করেছেন। এখানে খ্রিস্টান প্রচারকরা যদি আদামা অর্থে শুধু একজন আদি মানব হযরত আদম (আঃ)-কে বুঝাতে চান, তাহলেও এ থেকে তাদের কুসংস্কারের প্রতিবাদ হয়ে যায়। কারণ, ধর্মীয় কারণে তারা বিশ্বাস করেন যে, হযরত আদম (আঃ) বিনাপিতামাতায় সৃষ্ট হয়েছিলেন। সুতরাং, যীশু ‘বিনাপিতায় পয়দা’ বলে যদি খোদার পুত্র খোদা হওয়ার অধিকারী হন তবে শুধু পিতা নয় মাতারও সংস্রব ছাড়া জন্ম যে হযরত আদমের, তিনি তো তার অপেক্ষা বৃহত্তর খোদা হওয়ার অধিকারী নন কি?
‘Son of God’ প্রসঙ্গঃ
খ্রিস্টানধর্ম প্রচারকগণ যীশুর খোদাত্বের প্রমাণস্বরূপ নতুন নিয়মে যীশুর জন্য ব্যবহৃত Son of God বা ‘খোদার পুত্র’। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, যীশুকে যেহেতু খোদার পুত্র, বলা হয়েছে, সেহেতু তারা খোদার পুত্রকেও খোদারূপে মান্য করেন। শাস্ত্রজ্ঞানের স্বল্পতার কারণেই খ্রিস্টানরা এই ভ্রমে পতিত। যদি তারা ভালভাবে শাস্ত্রপাঠান্তে চিন্তা করতেন, তবে দেখতে পেতেন, বাইবেলের নতুন ও পুরাতন উভয় নিয়মেই খোদাপ্রাপ্ত অসংখ্য পবিত্র ব্যক্তিকে রূপকভাবে ‘খোদা বা খোদার পুত্র’ আখ্যা দেয়া হয়েছে, কিন্তু এজন্য তারা কেউই প্রকৃত খোদা বা খোদার পুত্র হয়ে যাননি। যেমন–ইহুদীরা যখন যীশুকে পাথর মারতে উদ্যত হয় তখন যীশু বললেন, “কেন আমাকে পাথর মার? ইহুদীরা তাকে উত্তর দিল, কারণ, তুমি মানুষ, অথচ নিজেকে খোদা করে তুলছ, এজন্য। যীশু তাদেরকে উত্তর দিলেন, তোমাদের ব্যবস্থায় কি লেখা নেই, ‘আমি বললাম, তোমরা খোদা’? যাদের নিকট খোদার বাক্য উপস্থিত হয়েছিল, তিনি যদি তাদেরকে খোদা বললেন–আর শাস্ত্রের খণ্ডন ত হতেই পারে না–তবে যাঁকে পিতা পবিত্র করলেন ও জগতে প্রেরণ করলেন, তোমরা কি তাকে বল যে, তুমি খোদা নিন্দা করছ। কারণ, আমি বললাম যে, আমি খোদার পুত্র?” (যোহন, ১০: ৩২-৩৬)। এখানে ইহুদীদের মিথ্যা অপবাদ খণ্ডন করে যীশু বলছেন যে, ইহুদী-শাস্ত্ৰ গীত সংহিতার ৮২: ৬ পদে যেরূপ রূপকভাবে খোদার বাক্য লাভকারী ব্যক্তিদেরকে খোদা বলা হয়েছে তেমনই তিনিও রূপকভাবে খোদার পুত্র। অন্যত্র যীশু বলেন, “ধন্য যারা মিলন করে দেয়, কারণ তারা খোদার পুত্র বলে আখ্যায়িত হবে।” (মথি, ৫: ৯)। এরূপ বাইবেলে আরও বহু লোককে রূপকভাবে খোদার পুত্র বলা হয়েছে। যেমন–“সদাপ্রভু এই কথা বলেন, ইস্রায়ীল আমার পুত্র, আমার প্রথম জাত” (যাত্রা পুস্তক, ৪ : ২২)। “তুমি আমার পুত্র” (গীত সংহিতা, ২ : ৭)। “শলোমন খোদার পুত্র” (১ বংশাবলী, ২২ : ১০; ২৮ : ৬)। “যত লোক খোদার হুকুম দ্বারা চালিত হয়, তারাই খোদার পুত্র” (রোমীয়, ৮: ১৪)। “আমরা খোদার সন্তান” (রোমীয়, ৮ : ১৬)। “তোমরা আপনাদের খোদা সদাপ্রভুর সন্তান” (দ্বিতীয় বিবরণ, ১৪ : ১)। “আমাদের একমাত্র পিতা আছেন, তিনি খোদা” (যোহন, ৮: ৪১) “খোদা আপন পবিত্র বাসস্থানে পিতৃহীনদের পিতা” (গীত সংহিতা, ৬৮ : ৫)। “পৃথিবীতে কাউকে ‘পিতা’ বলে সম্বোধন করো না, কারণ তোমাদের পিতা একজন, তিনি সেই স্বর্গীয়” (মথি, ২৩ : ৯) অতএব, যীশু খোদা অথবা খোদার পুত্র নন, তিনি খোদার বাক্য লাভকারী এক পবিত্র ভাববাদী, নবী। বাইবেলে অন্যান্য লোককে যেমন খোদার পুত্র বলা হয়েছে, তেমনই যীশুকেও খোদার পুত্র বলা হয়েছে রূপকভাবে।