যাহোক, এখন কিছু নজির উপস্থাপন করে দেখার প্রয়াস পাব যে যীশু খোদা অথবা খোদার পুত্র কোনটিই ছিলেন না; এরূপ দাবী তিনি কখনও করেননি; বরং, তিনি ছিলেন খোদার প্রেরিত একজন নবী–ভাববাদী।
বিনাপিতায় জন্ম খোদাত্বের প্রমাণ নয়:
জগতের দু’টি জাতি, খ্রিস্টান ও মুসলমান একমত পোষণ করে যে যীশুর জন্ম সাধারণ নিয়ম বহির্ভূত হয়েছে। তবে খ্রিস্টান জাতি একে অতিপ্রাকৃতিক (Supernatural) বা অলৌকিক বলে এবং ইহুদীরা একে অবৈধ (illegitimate) বলে মনে করে (Jew. Ency.)। এছাড়া পারিবারিক জন্ম-তালিকাতেও যীশুর জন্ম এরূপেই লিপিবদ্ধ রয়েছে (Tulmud)। শুধু এই বাস্তব ঘটনাটিই গ্রহণযোগ্য প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করে যে, যীশুর জন্ম অসাধারণ ছিল। উল্লেখ্য, মথি লিখিত সুসমাচার অনুযায়ী মরিয়মের স্বামী যীশুর জন্মের পূর্বপর্যন্ত দাম্পত্য জীবনের কোন সম্পর্ক স্থাপন করেননি (১: ২৫)
প্রকৃতপক্ষে, খ্রিস্টান ও ইহুদী জাতি যীশুর জন্মকে অতিপ্রাকৃতিক ও অবৈধ বলে মনে করে, কিন্তু তাঁর জন্ম অতিপ্রাকৃতিকও ছিল না, অবৈধও ছিল না। অথচ, খ্রিস্টান জাতি যীশুর পিতৃহীন জন্ম’কে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে বলে থাকে যে, তিনি মানব-সৃষ্টির সাধারণ নিয়মের বিপরীত বিনাপিতায় জন্ম গ্রহণ করেছেন (মুসলমানরাও এ কথা স্বীকার করেন)। সুতরাং, এই অলৌকিক জন্মের জন্যই তাকে খোদা বলে মানতে হবে। কিন্তু জননীর জরায়ুতেই যে তার প্রথম সঞ্চার ঘটেছিল এবং অন্যান্য জরায়ুজ জীবের ন্যায়ই ভ্রুণ-জীবের বিভিন্ন রূপ, স্তর ও আকারের মধ্যদিয়েই যে তাঁকে ক্রমশঃ পুষ্ট ও বর্ধিত হতে হয়েছিল, তাতে কোন মতভেদ নেই। ণতত্ত্ব (Embryology) সম্বন্ধে যার সামান্য কিছু জানা আছে, তাঁকে স্বীকার করতে হবে যে, জরায়ুতে ভ্রুণের সঞ্চার হতে ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত বাইরের একটি শক্তি বা নিয়মের অধীন হয়েই তাকে নানারূপে পরিবর্তিত হতে হয়। এ নিয়মের অধীন হয়ে যাকে আত্মপ্রকাশ করতে হয় খোদা সে নয়। বরং, সেই নিয়মের নিয়ামক যিনি তিনিই খোদা।
খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের যুক্তি হল, যেহেতু বিনাপিতায় শুধু যীশুই জন্মগ্রহণ করেছেন সেহেতু তিনিই খোদার পুত্র। তাই, বিনাপিতায় জন্মগ্রহণ করলে কেউ খোদার পুত্র হয় কিনা এবং এ ধরনের জন্য প্রকৃতিসম্মত কিনা তা আমরা প্রাচীন গ্রন্থ ও বিজ্ঞানের আলোকে আলোচনা করতে বা দেখতে পারি।
“কথিত আছে যে, লুম্বিনী উদ্যানে এক বিশেষ দর্শনলাভের পর রাণী মায়াদেবী গর্ভধারণ করেন এবং এমনিভাবে গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়। রাজা শুদ্ধোদন মহাত্মা বুদ্ধের প্রকৃত পিতা ছিলেন না। যোসেফের সাথে যীশুর যে সম্পর্ক শুদ্ধোদনের সাথেও গৌতমের সেইরূপ সম্পর্ক। মূলত, গৌতমের জন্য বিনাপিতায়ই হয়েছিল (Budhism in Christianity, By Arther lillie)
হিন্দুধর্মগ্রন্থ, মহাভারতে রয়েছে, যীশুখ্রিস্ট যেভাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কর্ণও সেইভাবে বিনাপিতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বর্ণিত আছে, মহাত্মা শ্রীকৃষ্ণের পিতামহ নূর তার প্রথমজাত সন্তানকে মানত করেন। এই মানতের পর এক কন্যা-সন্তান ‘পৃথা’ জন্মগ্রহণ করেন। পৃথাকে কুন্তিভোজের তত্ত্বাবধানে ব্রাহ্মণ সেবায় রাখা হয়েছিল বলে ঐ কন্যা কুন্তি’ নামে আখ্যাত হন। কথিত আছে যে, কুন্তি দেবী কুমারীবস্থায় সূর্যের দ্বারা (প্রাকৃতিক নিয়ম) গর্ভবর্তী হন এবং কর্ণকে প্রসব করেন (আদি পর্ব, ১১১ অধ্যায়)।”
পূর্বোক্ত বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মের দুটো নজির ছাড়াও প্রাচীন পারস্যবাসীদের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস থেকে জানা যায়, খোদা ও মানুষের মধ্যে প্রধান মাধ্যম ‘মিথরা’র জন্ম হয়েছিল বিনাপিতায় একজন কুমারীর গর্ভে। আর এই বিশ্বাস খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দেও প্রচলিত থাকার প্রমাণ রয়েছে (দ্রষ্টব্য : Religions Of The World)।
অতএব, শুধু যীশুই যে বিনাপিতায় জন্মগ্রহণ করেননি, তা বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম এবং পারস্যে প্রচলিত একটি নজির থেকেও জানা গেল। প্রকৃতপক্ষে, বিনাপিতায় জন্মগ্রহণ প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়। বিজ্ঞানের গবেষণায়ও বিষয়টি এখন সমর্থিত। কারণ, মাতৃগর্ভে (জরায়ুতে) উৎপন্ন ডিম্বাণুর দ্বারা সন্তান উৎপাদনের জন্য পিতৃপুরুষের সংমিশ্রণ যে একান্তই জরুরি, তা নয়। পুরুষ-বীর্যের সহায়তা ছাড়াই স্ত্রী ডিম্বাণুর স্ফুটন ঘটতে পারে, যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘বিনা নরে জন্ম’ বা ‘পার্থেনোজেনেসিস’ (Parthenogenesis) বলা হয়। এ সম্বন্ধে The World Book of Dictionary বলে, কোন পুরুষ সংসর্গের প্রভাব ছাড়াই প্রজনন, যেমন কোন কোন কীট-পতঙ্গের মাঝে বিপরীত লিঙ্গের সংসর্গ ছাড়াই কুমারী স্ত্রী-ডিম্বকোষের উর্বরতা ঘটে থাকে, পার্থেনোজেনেসিস বা বিনা নরে জন্ম কীট পতঙ্গের মাঝে অতি সাধারণ হলেও বড় জাতের প্রাণীদের মাঝে তা কখনো কখনো ঘটে।
Macmillan Family Encyclopaedia (Vol. 15. P-100) বলে, নারীদের ক্ষেত্রে একটি ডিম্বকোষের মাঝে যখন প্রাথমিক বিভাজন ঘটে তখন দুটি কোষের উৎপত্তি হয়। কোষ দুটির প্রত্যেকটিতে নির্দিষ্ট (ডিপ্লয়েড) সংখ্যক ক্রোমোজোম থাকে। এদের একটি কোষ উপযুক্ত পুষ্টির অভাবে ক্ষয়গ্রস্ত হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় একে প্রাথমিক পোলার বডি বলা হয় এবং এটি অপর কোষের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। ডিম্বকোষের প্রবৃদ্ধির এই স্তরে এসেই যৌন সংসর্গবিহীন বা বিনা-নরে জন্মদানের রতিক্রিয়ার উদ্দীপনা জোটে। এ ধরনের রতিক্রিয়াকালে ডিম্বকোষের দ্বিতীয় বিভাজন ঘটে। দু’ভাবে এটি ঘটতে পারে: হয় যুক্ত ক্রোমোজোম পৃথক হয়ে যাবে এবং প্রতিটি সদৃশ ক্রোমোজোম এলোমেলো কিছু পরিপূরক ক্রোমোজোমকে ফেলে দ্বিতীয় অবর্তী দেহ নিয়ে বাইরে বিক্ষিপ্ত হবে; না হয় দ্বিতীয় পোলার বডি সৃষ্টি হবে না। এ কারণে ডিম্বকোষের মাঝে নির্দিষ্ট (ডিপ্লয়েড) সংখ্যক ক্রোমোজোম রয়ে যাবে। যৌন সংসর্গবিহীন জন্ম কখনো কখনো এই দ্বিতীয় প্রকারের ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্যেই ঘটে থাকে। উল্লেখ্য, রুশ বিজ্ঞানী Dr. Igor Golman বিনাপিতায় জন্ম লাভ সম্বন্ধে অনেক তথ্য প্রকাশ করেছেন এবং এরকম জন্মের সম্ভাবনা স্বীকার করেছেন (Daily Express, Jesselton, 14 October, 1966)। তাছাড়া, Sunday Pictorial, November, 1955 সংখ্যায় প্রকাশিত হয় যে, বিজ্ঞানীদের মতে কোন কোন নারী দেহে একপ্রকার টিউমার হয়ে থাকে, এতে পুরুষের ন্যায় শুক্রকীটের উদ্ভব হয়। কখনো কখনো এই টিউমার থেকে শুক্রকীট বের হয়ে ডিম্বকোষে প্রবেশ করে এবং এতে কখনো কখনো গর্ভের সঞ্চার করে, যদিও তা খুবই বিরল। পত্রিকাটিতে কয়েকজন কুমারী মাতার নামও প্রকাশ করা হয়েছে। বিখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী Lancet-এ বলা হয়েছে যে, চিকিৎসা বিজ্ঞান তথা জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রকৃতির বিশেষ ব্যবস্থাধীনে যৌন-সংসর্গ ব্যতীত সন্তান জন্ম বা পুরুষের স্পর্শ ব্যতিরেকে নারীর সন্তান উৎপাদনের সম্ভাব্যতাকে অসম্ভব বলা যায় না। চিকিৎসাবিদগণ নারীর শ্রোণীতে বা নিাঙ্গের মধ্যে কখনো কখনো প্রাপ্ত ‘আরহেনোব্লাস্টোমা’ নামক একপ্রকার বিশেষ টিউমারের কারণে এই সম্ভাবনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এসব টিউমার পুরুষ শুক্রাণু এবং পুং-জনন কোষ উৎপাদন করতে সক্ষম। যদি এই আরহেনোক্লাস্টোমা দ্বারা কোন নারীদেহে স্বক্রিয় বা জীবিত পুং-জনন কোষ সৃষ্টি হয় তবে সেই নারী কুমারী হলেও তার গর্ভধারণ করার সম্ভাব্যতা অস্বীকার করা যায় না। সেই নারীর দেহ এমনভাবে ক্রিয়াশীল হবে যেন কোন পুরুষ-দেহ থেকে শুক্রাণু সাধারণ প্রক্রিয়া দ্বারা অথবা কোন চিকিৎসা-বিজ্ঞানীর সাহায্যে তার দেহে স্থানান্তরিত হয়েছে। সম্প্রতি ইউরোপের স্ত্রীরোগ বিশারদগণ সন্তান-প্রসবের দৃষ্টান্ত প্রমাণ করতে এমন তথ্য প্রকাশ করেছেন যেখানে প্রসূতি-মাতার কোন সম্পর্ক বা সংযোগ কোন পুরুষের সঙ্গেই ছিল না। Lancet-এর এই বিষয়টির বিস্তারিত তথ্য-বিবরণ লন্ডন থেকে W. B. Saunders & Co. কর্তৃক প্রকাশিত Anomalies and Curiosities of Medicine নামক পুস্তকে George M. Gould, A.M. M.D. এবং Walter L. Payle, A.M., M.D. কর্তৃক আরও জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে :