১৫. মনে রাখ যে, উপরিস্থ স্বর্গে ও নীচস্থ পৃথিবীতে সদাপ্রভুই খোদা, অন্য কেউ নেই” (দ্বিতীয় বিবরণ, ৪: ৩৯)।
১৬. তোমরা আপনাদের খোদা সদাপ্রভুরই অনুগামী হও, তাঁকেই ভয় কর, তাঁরই আজ্ঞা পালন কর, তাঁরই রবে অনুধাবন কর, তারই সেবা কর ও তাতেই আসক্ত থাক” (দ্বিতীয় বিবরণ, ১৩ : ৪)।
১৭. “অতএব, হে সদাপ্রভু খোদা, তুমি মহান; কারণ তোমার তুল্য কেউই নেই, ও তুমি ব্যতীত কোন খোদা নেই, আমরা স্বকর্ণে যা যা শুনেছি, তদনুসারে ইহা জানি” (২ শমূয়েল, ৭: ২২)।
বাইবেলের নতুন নিয়ম পাঠ করলেও জানা যায়, যীশু কখনও তিন খোদার কথা প্রচার করেননি, বরং এক খোদা ও একত্ববাদই প্রচার করতেন, যেমন–
১. “হে ইস্রায়ীল! শুন, আমাদের খোদা প্রভু একই প্রভু; আর তুমি তোমার সমস্ত অন্তঃকরণ, তোমার সমস্ত প্রাণ, তোমার সমস্ত মন ও তোমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমার খোদা প্রভুকে প্রেম করবে” (মার্ক, ১২ : ২৯-৩০; দ্বিতীয় বিবরণ, ৬ : ৪-৫)।
২. “সকলের খোদা ও পিতা এক, তিনি সবার উপরে, সবার নিকটে ও সবার অন্তরে আছেন” (ইফিষীয়, ৪ : ৬)।
৩. “এবং খোদা এক ছাড়া দ্বিতীয় নেই; … দেবতা নামে খ্যাত কিছু যদি স্বর্গে, অথবা পৃথিবীতে থাকে …. তথাপি আমাদের একমাত্র খোদা আছেন, তিনি পিতা, তার থেকে সকলই হয়েছে ও আমরা তারই জন্য” (করিন্থিয়, ৮: ৪-৬)
৪. “আমি আলফা এবং ওমিগা, আদি এবং অন্ত–ইহা প্রভু খোদা বলেন। যিনি আছেন ও যিনি ছিলেন ও যিনি বিরাজ করছেন, যিনি সর্বশক্তিমান” (প্রকাশিত বাক্য-১: ৮)।
যীশুকে ‘খোদার পুত্র খোদা’ বলার কল্পকাহিনী:
এখন খ্রিস্টানবিশ্ব যীশুখ্রিস্টকে খোদার পুত্র বলে জানে এবং বলে থাকে তিনি খোদার জীবন্ত প্রতিরূপ (Incarnation of God)। এই বিশ্বাসটি তাদের মতো আরও অনেক পৌত্তলিক জাতির মধ্যেও প্রচলিত ছিল। কিন্তু যীশুর এই পুত্রত্বের সাথে খ্রিস্টান জগত আরও যেসব বিশ্বাস ও সংস্কারের সংযোগ ঘটিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে তার নজীর নেই।
খ্রিস্টানদের মতে সাবেক সদাপ্রভু বা পিতা খোদাকে পূর্বে কেউ দেখেনি। অর্থাৎ “একজাত পুত্র, যিনি পিতার ক্রোড়ে থাকেন, তিনিই তাঁকে প্রকাশ করেছেন” (ব্যাপ্টিষ্ট মিশন, ১৯২৮-পরিবর্তনসহ)।
Begotten Son অর্থ ঔরসজাত পুত্র। সুতরাং, প্রথম পদের অর্থ হবে “একমাত্র ঔরসজাত পুত্র”। একজাত শব্দের দ্বারা Only begotten পদের যথার্থ তাৎপর্য জানা যায় না। তাছাড়া, বাইবেলে বলা হয়েছে যে, যীশুর আবির্ভাবের পূর্বপর্যন্ত যে খোদা কুদরতের কারখানা যথানিয়মে চালিয়ে আসছিলেন, সম্ভবতঃ নিরাকার বলে, কেউ তাঁকে দর্শন করতে পারেনি। কিন্তু যীশুখ্রিস্ট নিজেকে প্রকাশ করে, তাকেই জড় দেহের মধ্যদিয়ে প্রকাশ করে দিয়েছেন। সুতরাং, যীশুকে খোদার পুত্র করে দেয়ার জন্য খ্রিস্টান জগৎ পৌত্তলিকতার কোন অন্ত স্থলে গিয়ে উপনীত হয়েছে, এসব সংস্কার থেকে তার পরিচয় পাওয়া যায়। অথচ, এটা কখনোই যীশুর শিক্ষা ছিল না। প্রাথমিক যুগের ধর্মপরায়ণ সাধু ব্যক্তিদের সাথেও এর কোন সম্বন্ধ সংস্রব ছিল না (দেখুন, Encyclopeadia of Biblica, “Son of God”)। এ সম্বন্ধে ভলতেয়ারের উক্তিগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ভলতেয়ার বলেন, খ্রিস্টের ঈশ্বরত্ব নিয়ে যে বিরাট প্রশ্নটি খ্রিস্টান ধর্মমণ্ডলীর হৃদয় আলোড়িত করেছিল, খ্রিস্টের পর ৩২৪ অব্দে রোম সম্রাট কনস্টেনটাইন কর্তৃক আহূত নিসিয়া সম্মেলনে তা মীমাংসিত হয়। এই সভায় অন্যূন আঠারোজন বিশপ এবং দু’হাজার সাধারণ পাদ্রী যীশুর ঈশ্বরত্ব অস্বীকার করেন এবং তা নিয়ে বিরুদ্ধ-তর্ক করেন। কিন্তু অনেক ক্রদ্ধ বাদানুবাদ ও বিরুদ্ধ তর্কবিতর্কের পর যীশুকে ‘পিতা পরমেশ্বর কর্তৃকজাত তার একমাত্র পুত্র বলে ঘোষণা করা হয়। বিরুদ্ধবাদী আঠারোজন বিশপের অন্যতম এরিয়াস একত্ববাদী অর্থাৎ খ্রিস্টের ঈশ্বরত্বে আস্থাহীন ব্যক্তিদেরকে পরিচালিত করেন এবং এই কাজের জন্য তিনি ধর্মদ্রোহী বিবেচিত হওয়ায় নির্বাসিত হন। কিন্তু অবিলম্বেই কনস্টান্টিনোপলে (বর্তমান ইস্তাম্বুল) পুনরাহূত হয়ে নিজের ধর্মমতকে প্রবল করতে সমর্থ হন। ত্রিত্ববাদীদের নেতা। তার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চিরশত্রু এথানাসিয়াসের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তার ধর্মমতসমূহ সমগ্র রোম জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।”
‘খ্রিস্টান পুরোহিতদের দ্বিতীয় সম্মেলন কনষ্টানটিনোপলে ৩৮১ খ্রিস্টাব্দে বসেছিল। নিসিয়া সম্মেলনে ‘পবিত্র-আত্মা সম্বন্ধে যা অসীমাংসিত রয়ে গিয়েছিল, এই সভায় তা পরিষ্কার করে নেয়া হয় এবং এই সম্মেলনে সিদ্ধান্তহয় যে, প্রভু পবিত্ৰাত্মাই মূলতঃ পিতা থেকে সমুৎপন্ন এবং পিতা ও পুত্রের সাথে একত্রে সম্মিলিত এবং একই সাথে গৌরবান্বিত হন। পবিত্র আত্মা পিতা এবং পুত্র থেকে জাত হয়েছেন। এই ধর্মমত নবম শতাব্দীর পর থেকে ক্রমশঃ লাতিন ধর্ম সম্প্রদায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। ৪৩১ খ্রিস্টাব্দে ইফিসাসে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সাধারণ সম্মেলনে ইহা নির্ধারিত হয় যে, মেরী প্রকৃতই ঈশ্বরের জননী। সুতরাং, যীশুর দুটি স্বভাব এবং একটি দেহ। এ নিয়ে নবম শতাব্দীতে লাতিন ও গ্রীক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিষম মতভেদের সৃষ্টি হয়, এরপর পোপের পদ নিয়ে মতভেদের জন্য রোম শহরে অন্যূন ঊনত্রিশটি মারাত্মক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।” (Voltair Quoted, 6th Essay, P-23-24)।