ত্রিত্ববাদ ও যীশু
ত্রিত্ববাদ (Trinity) খ্রিস্টধর্মের বৈশিষ্ট্য। খ্রিস্টান ধর্মগুরুদের মতে, খোদার তিন রূপ–পিতা খোদা (God the Father), পুত্র খোদা (God the Son) এবং পবিত্র আত্মা খোদা (God the Holy Spirit)। সাধু পৌল প্রচারিত এবং ৩৮১ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত প্রাচীন খ্রিস্টান দুনিয়ার দ্বিতীয় সার্বভৌম ক্যাথলিক ধর্মসভার আহ্বায়ক সম্রাট থিয়োডোসিউস কর্তৃক ঘোষিত মতবাদ একের ভিতরে তিন (The Doctrine of the Trinity) অনুসারে খ্রিস্টানগণ বলেন পিতা, খোদা স্রষ্টা, সকল কিছুর আদি উৎস; পুত্র হিসেবে তিনি যীশুর মধ্যে মূর্ত এবং পবিত্র আত্মা হিসেবে তিনি সকল সৃষ্টির মধ্যে এবং আমাদের আত্মার মধ্যে বিরাজমান। এককথায়, খ্রিস্টানগণ বিশ্বাস করেন, একই খোদার সমমর্যাদাসম্পন্ন ও সমশক্তিসম্পন্ন তিনটি রূপের মধ্যদিয়ে প্রকাশ ঘটে–পিতা, পুত্র এবং পবিত্র আত্মার। অর্থাৎ, খ্রিস্টানরা এক খোদয় বিশ্বাস করেও এক ঐক্যের মধ্যে তিনের বিভেদের কথা বলে থাকেন। তাদের মতে, পিতা খোদা, পুত্র খোদা এবং পবিত্র আত্মা খোদা–এই তিন খোদার প্রত্যেকটি হচ্ছেন পূর্ণ ও স্বতন্ত্র খোদা। আবার এই তিন খোদা মিলে হচ্ছে এক পূর্ণ খোদা। কিন্তু এই মতবাদ্ধ যে অবিশ্বাস্য এবং ব্যবহারিক জীবনে অচল তার প্রমাণ মেলে ভারতীয় একজন ইসলাম ধর্ম প্রচারক ডক্টর মুফতি মুহম্মদ সাদেক-এর একটি উপমা থেকে।
‘১৯২০ সালে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে মুফতি মুহম্মদ সাদেক যান ভারত থেকে আমেরিকায়। সেখানে তিনি চিকাগোর ওয়াবাস (Wabash) এভিনিউতে একদিন এক বইয়ের দোকান-মালিককে খ্রিস্টধর্মীয় মতবাদের (ত্রিত্ববাদের) অসারতা বুঝাতে গিয়ে একটি বই পছন্দ করেন। ঐ দোকানের সকল বইয়ের মূল্যই তিন সেন্ট ছিল। ফলে, দোকান-মালিক বইটির মূল্য তিন সেন্ট চাইলে ডক্টর সাহেব তাকে পকেট থেকে শুধু একটি সেন্ট বের করে দেন। এতে দোকান-মালিক তাঁকে জানালেন যে তিনি ভুল করছেন, তাকে আরও দু’সেন্ট দিতে হবে। এতে ডক্টর সাহেব তাঁকে বললেন, “সে কি কথা! আমি তো ঠিকই দিয়েছি; আপনি কি বিশ্বাস করেন না তিনে এক, একে তিন?” এতে দোকান-মালিক লজ্জিত হয়ে বললেন, “ওটা তো ধর্মের কথা, ব্যবসায়তে ওটা চলে না।” অথচ তিন খোদা এক এবং এক খোদা তিন এই জাজ্বল্যমান মিথ্যে মতবাদ প্রচার করে খ্রিস্টানরা বিশ্বকে বিভ্রান্ত করছে। পাশ্চাত্য জাতি সূক্ষাতিসূক্ষ্ম হিসেবে পারদর্শী হয়েও এক যে তিন হয় না এবং তিন যে এক হয় না, ধর্মের ব্যাপারে এই সহজ সত্য কথা তারা বুঝে না, তারা এমনি অন্ধ।’
যাহোক, ‘তিন খোদা এবং এক খোদা তিন’–এই অভিনবত্ব বাইবেলের নতুন নিয়মের সৃষ্টি, পুরাতন নিয়মে এমন নয়। সেখানে খোদা এক ও অদ্বিতীয়রূপেই ব্যাখ্যাত হয়েছে, যেমন–
১. “তোমরা যেন জানতে ও আমাকে বিশ্বাস করতে পারো এবং বুঝতে পারো যে, আমিই তিনি, আমার পূর্বে কোন খোদা নির্মিত হয়নি, এবং আমার পরেও হবে না। আমি, আমিই সদাপ্রভু আমি ভিন্ন আর ত্রাণকর্তা নেই” (যিশাইয়র, ৪৩ : ১০-১১)।
২. সদাপ্রভু এই কথা বলেন, আমিই আদি, আমিই অন্ত, আমি ভিন্ন আর কোন খোদা নেই” (যিশাইয়, ৪৪ : ৬)।
৩. “তথাপি আমিই মিশর দেশ অবধি তোমার খোদা সদাপ্রভু আমাকে ব্যতিরেকে আর কোন খোদাকে তুমি জানবে না এবং আমি ভিন্ন ত্রাণকর্তা আর কেউ নেই” (হোশেয়, ১৩ : ৪)।
৪. “সদাপ্রভু এই কথা বলেন, আমি সদাপ্রভু সর্ববস্তু নির্মাতা, আমি একাকী আকাশমণ্ডল বিস্তার করেছি, আমি ভূতল বিছিয়েছি, আমার সঙ্গী কে?” (যিশাইয়, ৪৪ : ২৪)।
৫. “এখন দেখ, আমি, আমিই তিনি, আমি ব্যতীত কোন খোদা নেই” (দ্বিতীয় বিবরণ, ৩২: ৩৯)।
৬. “তবে তোমরা কার সাথে খোদার তুলনা দিবে? তাঁর সদৃশ বলে কি প্রকার মূর্তি উপস্থিত করবে? …. তুমি কি জ্ঞাত হওনি? তুমি কি শুননি? অনাদি অনন্ত খোদা, সদাপ্রভু, পৃথিবীর প্রান্তসমূহের সৃষ্টিকর্তা ক্লান্ত হন না, শ্রান্ত হন না; তার বুদ্ধির অনুসন্ধান করা যায় না” (যিশাইয়, ৪০: ১৮, ২৮)।
৭. “আকাশমণ্ডলের সৃষ্টিকর্তা সদাপ্রভু, স্বয়ং খোদা, যিনি পৃথিবীকে সংগঠন করে নির্মাণ করেছেন, তা স্থাপন করেছেন ও অনর্থক সৃষ্টি না করে বাসস্থানার্থে নির্মাণ করেছেন, তিনি এই কথা বলেন, আমি সদাপ্রভু, আর কেউ নয়” (যিশাইয়, ৪৫ : ১৮)।
৮. “হে প্রভু, দেবতাদের মধ্যে তোমার তুল্য কেউ নেই ….. কারণ, তুমি মহান এবং আশ্চর্য-কার্যকরী; তুমিই একমাত্র খোদা” (গীত সংহিতা, ৮৬: ৮, ১০)।
৯. “আর তারা জানুক যে, তুমি যার নাম সদাপ্রভু, একা তুমিই সমস্ত পৃথিবীর উপরে পরাৎপর” (গীত সংহিতা, ৮৩ : ১৮)।
১০. “পুরাকাল পর্যন্ত তুমি ভিন্ন আর কোন খোদা আছেন বলে লোকে শুনেনি, কর্ণে অনুভব করেনি, চক্ষুতে দেখেনি” (যিশাইয়, ৬৪ : ৪)।
১১. “আমাদের খোদা সদা প্রভুর তুল্য কেউ নেই” (যাত্রা পুস্তক, ৮:১০)।
১২. “সদাপ্রভুই খোদা, তিনি ব্যতীত আর কেউ নেই” (দ্বিতীয় বিবরণ, ৪: ৩৫)।
১৩. “হে সদাপ্রভু, তোমার তুল্য কেউ নেই, ও তুমি ব্যতীত কোন খোদা নেই” (১ বংশাবলী ১৭ : ২০)।
১৪. “হে ইস্রায়ীল, শুন : আমাদের খোদা সদাপ্রভু একই সদাপ্রভু” (দ্বিতীয় বিবরণ; ৬: ৪)।