শুধু পূর্বদেশেই নয়, প্রতীচ্যেও ধূমকেতুকে মঙ্গলজনক ঘটনার সাথে যুক্ত করার অন্ততঃ একটি পুরোনো নজির রয়েছে, তাও খ্রিস্টের জন্ম প্রসঙ্গেই।
১৩০১ সালে হ্যালীর ধূমকেতু পৃথিবীর আকাশে দেখা দিয়েছিল এক মনোহররূপে এবং সে ঘটনা প্রত্যক্ষ করার কিছুদিন পরেই ইতালীর সুধীশিল্পী জিয়োত্তো (Giotto) পাদুয়া (Padua) ভজনালয়ের জন্য একটি চিত্র অংকন করেন ‘অ্যাডোরেশন অব মেইজ মেজাই’ নামে।
প্রসিদ্ধ ওই চিত্রে তিনি জ্ঞানীব্যক্তিদের মাতার উপরে আকাশে একটি ধূমকেতুকেই স্থাপন করেছিলেন।
উল্লেখ্য যে, খ্রিস্টপূর্ব বারো অব্দের, ছাব্বিশে অক্টোবর পর্যন্ত আকাশে হ্যালির ধূমকেতু দেখা দিয়েছিল।
এভাবে, সম্প্রতি খ্রিস্টধর্মের গোড়ার ইতিহাস গবেষণায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, প্রচলিত খ্রিস্টাব্দের গণনা ভুল এবং যীশু ডিসেম্বর মাসে জন্মগ্রহণ করেননি, জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রচলিত খ্রিস্টীয় সনের এগারো বছর পূর্বে যখন বেথেলহেমের আকাশে হ্যালীর ধূমকেতু দেখা দিয়েছিল এবং সেখানকার খেজুর গাছে টাটকা-পাকা খেজুর ছিল, আর তখন মেষপালকরা রাত্রে তাদের মেষপালগুলো মাঠে চরাতে পারত।
ডিসেম্বর নিয়ে ভাবনা : এটি ক্রীষ্টমাস না কৃষ্ণমাস
খ্রিস্টান জাতি প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসকে ক্ৰীষ্টমাস হিসেবে যীশুখ্রিস্টের জন্মতিথি হিসেবে পালন করে আসছে। কিন্তু এই মাসটি দু’হাজার বছর বা তারও বেশিসময় ধরে জড়িয়ে আছে আরেকটি নামের সঙ্গে। খ্রিস্টানদের পূর্বে, আরও বহু জাতি এই মাসে তাদের আনন্দোৎসব পালন করতো। রোমকরা পালন করতো ‘Saturnalia’ আনন্দোৎসব। টিউটনরা (Teuton) পালন করতে ‘ইয়ূল’ উৎসব (Yule Festival)। আর ইহুদীদের বিখ্যাত ‘হানুখাহ্’ (Hanukhah) বা Festivial of lights উৎসবটিও অনুষ্ঠিত হয় তাদের কিসলেভ (Kislev) মাসের ২৫ তারিখে, যা সাধারণতঃ ডিসেম্বর মাসেই পড়ে। আর এই উপমহাদেশে ভারতের হিন্দুরা খ্রিস্টজন্মের বহুবছর পূর্ব থেকেই পালন করে আসছে ‘গীতা-জয়ন্তী’ উৎসব এবং এই মাসকে তারা অভিহিত করে আসছে কৃষ্ণমাস নামে। কারণ, এই মাসে নাকি মহাভারতের যুগের হিন্দু অবতার কৃষ্ণ তাঁর প্রিয় শিষ্য অর্জুনকে গীতা উপদেশ দিয়েছিলেন। তাই হিন্দুরা কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত বলে এই মাসকে ‘কৃষ্ণমাস’ নামে অভিহিত করে আসছে। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, খ্রিস্টানদের ‘ক্রিষ্টমাস’ এবং হিন্দুদের ‘কৃষ্ণমাস’ উৎসব নিয়ে আধুনিক বক্তব্য বেশ কৌতূহলোদ্দীপক।
পণ্ডিতগণ বলেন, কৃষ্ণমাস নামটি থেকেই মূলতঃ ক্রিষ্টমাস নামটি এসেছে। কারণ, কৃষ্ণের গীতা উপদেশের বহুপরে এমনকি রোম সভ্যতারও পতনের বহু পরে, মাত্র চতুর্থ শতাব্দীতে এসে ২৫শে ডিসেম্বর যীশুখ্রিস্টের জন্মদিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তাই আমাদের বক্তব্য ক্রিষ্টমাস এবং ডিসেম্বর মাসের পার্থক্য নিয়ে।
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর দ্বাদশ মাস বা শেষ মাস হলো ডিসেম্বর। প্রাচীন রোমক পঞ্জিকার দশম মাস। ‘ডিসেম্বর’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে। ‘Decem’ শব্দের অর্থ হলো দশ। আবার ‘দশম’ শব্দটির ল্যাটিন রূপ হলো ‘Decem’। ‘দশম অম্বর’ বা ‘দশ-অম্বর হলো অম্বর বা আকাশের দশম অংশ। আকাশকে মোট বারোটি ভাগে ভাগ করে প্রত্যেকটি ভাগকে একটি নির্দিষ্ট রাশির জন্য পৃথক করেন প্রাচীন ভারতীয়রা, যারা এই বারোটি রাশিচক্র অনুসারে বারো মাসের ভাগ ঠিক করেন। তাদের বছর আরম্ভ হতো মার্চ মাসের সময় থেকে। সে অনুসারে এই মাস দশম মাস। সূর্য তখন এই মাসে দশম রাশিচক্র অতিক্রম করতো। ভারতীয়দের এই অতিপ্রাচীন জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক মাস বিভাগ পরবর্তীকালে প্রাচীন রোমকরা গ্রহণ করে। প্রথমে গ্রীকরা নিয়েছিল এই বিভাজন। তারপর নেয় রোমকরা। ফলে, এই মাস গ্রীক বা রোমকদের বছরের দশম মাস হিসেবেই নির্দিষ্ট ছিল। তাই মাসের নাম ‘Decem-mber’ বা ‘December’, যা সংস্কৃত ‘দশম-অম্বর’ বা দশ-অম্বর’-এর ল্যাটিন এবং পরবর্তীকালে শুধু রোমীয় রূপান্তর। সুতরাং, ‘December’ নামকরণটি এসেছে সংস্কৃত নামকরণ থেকে। তাই গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীতে এই মাস দ্বাদশ মাস হলেও, প্রাচীন দশম মাসের নামটি এখনও ধরে রেখেছে এবং এই কথাই প্রমাণ করেছে যে গ্রীক ও রোমক সভ্যতা ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতার কাছে বহুকাল থেকেই সম্যকভাবে ঋণী।
খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে ভুল করেন যে, ক্রিস্টমাস হচ্ছে ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ। কিন্তু সংস্কৃত মাস’ শব্দটি থেকে বুঝা যায় যে, ক্রিষ্টমাস’ শব্দটির একটি পুরো মাস বোঝানোর সংস্কৃত ব্যঞ্জনা আছে। অনেকে এটাকে ‘X-mas’ ও বলেন। খ্রিস্টান বিশ্বাস অনুযায়ী ‘X-mas’-মানে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। এখানেও সেই একই ভুল। ‘x’ এই প্রতীকটি রোমানলিপিতে “১০” বুঝায়।’X mas’-অর্থ দশম মাস। আবার ল্যাটিন ‘Decem’ শব্দের অর্থও দশম। সুতরাং, ক্রিষ্টমাস বা ‘X-mas’-সম্পূর্ণ একটি মাসকেই বুঝাচ্ছে, কোন বিশেষ সপ্তাহ নয়। তাছাড়া, ‘mas’ (মাস) বলতে সম্পূর্ণ মাসটিই বোঝায়, কোন সপ্তাহ বা দিন নয়। ‘X-mas’-মানে দশম মাস, ‘December’ অর্থও দশম মাস এবং ‘Chirstmas’ অর্থ কৃষ্ণের নামে উৎসর্গীকৃত পুরো মাসটিই, বা কৃষ্ণমাস। এছাড়া, ‘Christmas Day’ বা ‘x-mas Day’ কথাটিও অর্থহীন। কারণ, এখানে মাসকে ‘Day’ বা দিনের সমার্থক ভাবা হচ্ছে। যীশুখ্রিস্টের জন্মদিন বোঝাতে মাসটিকে ‘Christmas’ না বলে দিনটিকে বলা যেতো ‘Christ Day’। প্রাচীনকাল থেকে তা কিন্তু বলা হয়নি। তাই বলতে হচ্ছে : খ্রিস্টমাস কথাটি দু’হাজার বছর বা তারও বেশি সময় ধরে জড়িয়ে আছে এই মাসের আরেকটি নামের সঙ্গে।