ঐতিহাসিকেরা তেমন মিথ্যা টিপ্পনি কাটেননি যে হেরোদকে দেখে মনে হত, যেন কোন হিংস্র পশু বন থেকে বেরিয়ে এসে জুডিয়ার সিংহাসনে বসে রাজত্ব করছে।
যাহোক, ঐতিহাসিকগণ পেয়েছেন, শিশু-হস্তা হেরোদ যে বছর মারা যান সেইবছর ইহুদীদের নিস্তার-পর্ব (passover) নামের বিশেষ উৎসবের অব্যবহিত পরেই একটি চন্দ্রগ্রহণ সংঘটিত হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ইহুদী ক্যালেণ্ডার সম্পর্কিত জ্ঞান এবং গ্রহণ সংক্রান্ত সূত্র প্রয়োগ করে জানান, তা ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব চার অব্দে। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা (১৯৮৬) সংস্করণ, পঞ্চদশ খণ্ড) বলে, Jesus was born a few years before the end of his (Herod) reign, w, where Jesus birth and early lot are set in the time of Herod I and the change of regime (4 BC). সুতরাং, বিষয়টি নানাদিক থেকে বিচারবিশ্লেষণ করে গবেষকরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, যীশুর জন্ম হয় খ্রিস্টপূর্ব ছয় অব্দে –তার আগেও হয়তোবা হতে পারে।
ড. এস. পিক জে, স্টুয়ার্ট হোয়েন ‘ডিড আওয়ার লর্ড অ্যাকচোয়্যালি লিভ?’ গ্রন্থে বলেন, পুস্তকে এঙ্গোরা মন্দিরগাত্রে রক্ষিত শিলালিপি এবং প্রাচীন চীনা ক্লাসিকে উদ্ধৃত সুদূর চীনে ২৫-২৮ খ্রিস্টাব্দে প্রাপ্ত সুসমাচারে বর্ণিত কাহিনীর বর্ণনা থেকে যুক্তির মাধ্যমে যীশুর জন্ম খ্রিস্টপূর্ব আট অব্দে সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর বলে নির্ধারণ করেছেন।
লুক লিখিত সুসমাচার থেকে জানা যায়, তাইবেরিয়াস সিজারের শাসনকালের পঞ্চদশ বছরে যখন পান্তিয়াস পীলাত ইহুদীদের দেশাধ্যক্ষ, হেরোদ গালীলের রাজা, তার ভ্রাতা ফিলিপ যিতূরিয়া ও ত্রাখোনীতিয়া প্রদেশের রাজা এবং লূষাণিয়া অবলিনী (Abilane)-এর রাজা তখন হানন (Annas) ও কায়াফা (Caiaphas)-এর মহাযাজত্বকালে সরিয়ের পুত্র যোহন (হযরত জাকারিয়ার পুত্র হযরত ইয়াহইয়া) প্রথম ঐশীবাণী (নবুয়ত) লাভ করেন (৩: ১-২)। উদ্ধৃত তিবিরিয়া কৈসরের শাসনকালের পঞ্চদশ বছরকে ব্রিটানিকা বিশ্বকোষ ২৮/২৯ খ্রিস্টাব্দ বলে উল্লেখ করেছে। সর্বদীসম্মত মত এই যে, যীশু ও যোহন সমবয়সী (ছয় মাসের ছোট-বড়) ছিলেন (লুক, ১ : ২৪-২৬) এবং যোহনের অব্যবহিত পরেই যীশু নবুয়ত লাভ করেন।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহ্ তায়ালা কাউকেই চল্লিশ বছর বয়সের পূর্বে নবুয়ত প্রদান করেননি এবং পবিত্র কোরআনেও নবুয়ত লাভের বয়স ৪০ বছর বলে উল্লিখিত হয়েছে (সূরা আরাফ, সূরা আল আহকাফ)। এই মতানুসারে যীশুর জন্ম হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব (৪০-২৮ =)১১/১২ অব্দে। আর এ বিষয়টি মথি বর্ণিত একটি আকাশীয় লক্ষণ থেকেও জানা যায়।
মথি লিখিত সুসমাচারে বর্ণিত রয়েছে, যীশুর জন্ম হওয়ার পরে পূর্বদেশ (খুব সম্ভবতঃ ভারত) থেকে ক’জন জ্ঞানী পণ্ডিত জেরুজালেমে এসে বলেন, ইহুদীদের যে রাজা জন্মেছেন তিনি কোথায়? কারণ, তার জন্মের লক্ষণস্বরূপ যে তারাটি উদিত হওয়ার কথা, তারাটি তারা পূর্বদেশে দেখেছেন এবং তাঁকে আশীর্বাদ করতে এসেছেন (২: ১-২)–এখানে সকল গবেষক-পণ্ডিতই প্রশ্ন তুলেছেন : যীশুর জন্মকালে পূর্বদেশের ক’জন (স্পষ্ট উল্লেখ না থাকলেও, মনে হয় তিনজন) জ্ঞানী পণ্ডিত আকাশে কি দেখেছিলেন, যা লোকমুখে আজও Star of Bethlehem বা বেথেলহেমের তারা বলে অভিহিত হয়ে আসছে?–এ সম্বন্ধে Ment Students Encyclopeadia (Vol, 4, P-469) বলে :
‘জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বাইবেলে (মথি, ২:২,৯) উল্লিখিত তারাটি নির্ণয়ের চেষ্টা করেন, যার অনুসরণ করে জ্ঞানী ব্যক্তিরা বেথেলহেমে এসেছিলেন। সম্ভাব্য তারাটি প্রথমত, এগারো খ্রিস্টপূর্বাব্দে বেথেলহেমের উপরে হ্যালীর ধূমকেতু দেখা দিয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ খ্রিস্টপূর্ব সাত বা আট অব্দে বৃহস্পতি, শনি ও মঙ্গলের কক্ষপথগুলো এমনভাবে একত্রে সন্নিবেশিত হয়েছিল যে পৃথিবী থেকে দেখলে মনে হতো, ওইসব গ্রহ থেকে বিচ্ছুরিত আলো এক বিন্দু থেকেই আসছে। সবশেষে, বেথেলহেমের তারাটি হয়তো বা একটি নোভা অর্থাৎ, এমন একটি তারা, যা হঠাৎ করেই অধিক উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে এবং কিছুসময় পরেই আবার আঁধারে মিলিয়ে যায়। যাহোক, খ্রিস্টের জন্ম তারিখ যখন নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়নি, তখন এসব সূত্রের কোনটিকেই সত্য বলে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি।”
তবে, পণ্ডিতদের অধিকাংশই উল্লিখিত তারাটিকে ধূমকেতু বলে বিশ্বাস করেন। আবার কেউ কেউ তা অশুভ ঘটনার প্রতীক বলে নাকচ করে দিয়েছেন। কিন্তু, বিষয়টি একেবারে অসম্ভব নয়। কারণ, পরবর্তীকালে ধূমকেতু অমঙ্গলের প্রতীকে পরিণত হলেও প্রাচীনকালে ধূমকেতু সর্বক্ষেত্রে অবিমিশ্র মন্দ বলে বিবেচিত ছিল না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ষষ্ঠ শতাব্দীর ভারতীয় জ্যোতির্বিদ বরাহ মিহির এর কথা বলা যায়, তিনি তাঁর গ্রন্থ ‘বৃহৎ সংহিতায় প্রধানতঃ পূর্বসূরীদের মতামতের সারকথা একত্রে পরিবেশন করে রায় দেন আকার, আকৃতি, স্থায়ীত্ব ইত্যাদির তারতম্য অনুযায়ী ধূমকেতু শুভ বা অশুভ–দুয়েরই ইঙ্গিত বহন করতে পারে। শুধু তাই নয়, দুর্নামের পাশাপাশি কিছু সুনামও যে ধূমকেতুরা বেশ প্রাচীনকাল থেকেই অর্জন করে তাও তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন।
আর এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে, বাইবেলোক্ত প্রাজ্ঞ-ব্যক্তিরা যান পূর্বদেশ থেকে এবং খুব সম্ভবতঃ তারা ধর্মবেত্তা পণ্ডিত ও জ্যোতিষী ছিলেন বলেই তারা আকাশে পরিলক্ষিত ঘটনার পার্থিব অর্থ করেছিলেন।