উপস্থিত সবাই বলল, এইক্সের আদালতে।
বিশপ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, সরকারপক্ষের উকিলের কোথায় বিচার হবে?
দিগনেতে একবার একটি বড় সকরুণ ও মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে। এক খুনের আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়। আসামিটি একেবারে নিরক্ষর নয়। আবার খুব একটা শিক্ষিতও নয়। তার বিচার শহরের লোকদের মনে এক বিরাট কৌতূহলের সৃষ্টি করে। লোকটির ফাঁসির দিনে এই কারাগারের যাজক অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফাঁসির সময় একজন যাজকের দরকার। স্থানীয় হোট গির্জার যাজককে ডাকা হলে সে বলে এটা তার কাজ নয়, তাছাড়া সে অসুস্থ। তখন বিশপ মিরিয়েলকে এই খবরটা জানানো হয়।
বিশপ তখন বলেন, যাজক ঠিকই বলেছেন, এ কাজ তাঁর নয়, আমার।
তিনি তৎক্ষণাৎ জেলখানায় সেই ফাঁসির আসামির ঘরে চলে গেলেন। তিনি লোকটির নাম ধরে ডেকে তার একটি হাত ধরে তার সঙ্গে পরম আন্তরিকতা ও অন্তরঙ্গতার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। কোনও কিছু না খেয়েই সারাটি দিন ও রাত। তিনি লোকটির সঙ্গে জেলখানাতেই রয়ে গেলেন। তার আত্মার শান্তি কামনা করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন তিনি। তাকে আত্মস্থ হওয়ার জন্য উপদেশ দিলেন। জীবন, মৃত্যু ও ঈশ্বর সম্বন্ধে গভীরতম সত্যের কথাটি খুব সহজ ও সরলভাবে তাকে বললেন। তিনি তার সঙ্গে এমনভাবে মেলামেশা করতে লাগলেন যাতে মনে হবে তিনি একেবারে লোকটির পিতা, ভ্রাতা এবং বন্ধু। আবার বিশপরূপে তাকে আশীর্বাদ করলেন। লোকটি ফাঁসির কথা শুনে হতাশ হয়ে পড়ে। নিবিড়তম হতাশার মধ্য দিয়েই। জীবনাবসান ঘটত তার। যে মৃত্যুকে সে এক অন্ধকার শূন্যতা বলে ভাবত সেই মৃত্যুর সামনে এসে এক অপরিসীম বিভীষিকার কথা চিন্তা করে কাঁপতে থাকে সে। যে রহস্যময় এক অবগুণ্ঠন মৃত্যুকে জীবন ও আমাদের চোখের দৃষ্টিপথ থেকে আড়াল করে ঢেকে রাখেন, লোকটির মৃত্যুদণ্ডের সংবাদ সে অবগুণ্ঠনকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। তখন সেই ছিন্নভিন্ন অবগুণ্ঠনের অচ্ছন্দ অবকাশের মধ্য দিয়ে মৃত্যুলোকের পানে তাকিয়ে সে শুধু দেখতে পেল রাশিকৃত এক বিপুল অন্ধকার। কিন্তু বিশপ সেই অন্ধকারের মাঝে আলো দেখালেন তাকে।
পরদিন সকালে আসামিকে যখন বধ্যভূমির দিকে হাতবাঁধা অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন বিশপও তার পাশে পাশে যাচ্ছিলেন। তাঁর মাথায় ছিল বিশপের মস্তকাচ্ছাদন আর গলায় ক্রসটা ঝোলানো ছিল। লোকটির যে মুখখানা গতকাল বিষাদে কালো হয়ে ছিল আজ সে মুখ এক অজ্ঞাত, অকারণ ও অনাবিল আনন্দের জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। জীবনের শেষ মুহূর্তে মৃত্যুলোকের দ্বারপ্রান্ত অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরকে পাওয়ার আশায় সহসা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে যেন তার প্রশান্ত ও স্থিতধী আত্মা। ঘাতকের খড়গ লোকটির উপর পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে বিশপ তাকে চুম্বন করে বললেন, মনে রেখো, মানুষ যাকে হত্যা করে ঈশ্বর তাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। ভাইরা কাউকে বন্দি করলে পরম পিতা ঈশ্বর তাকে মুক্ত করেন। এখন প্রার্থনা কর, ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখ এবং মহাজীবনের পথে গমন কর যেখানে আছেন তোমার পরম পিতা।
বিশপ যখন তাঁর কাজ শেষ করে বধ্যভূমি থেকে বেরিয়ে এলেন তখন তার চোখের দৃষ্টি দেখে সবাই বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল। সে দৃষ্টির মধ্যে তখন একই সঙ্গে ছিল এক সকরুণ গ্লানিমা আর উজ্জ্বল প্রশান্তি। কোনটা বেশি আকর্ষণ করছে তাদের, তা বুঝতে পারল না কেউ।
সেদিন বাড়ি ফিরে বিশপ তাঁর বোনকে বললেন, আমি এতক্ষণ আমার কর্তব্য পালন করছিলাম।
জীবনে এমন অনেক মহৎ কাজ আছে যার মানে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। দিগনে শহরের অনেক লোকও তেমনি বিশপ মিরিয়েলের অনেক মহৎ কাজের মানে বুঝতে পারত না। বলত, ওটা বিশপের এক কৃত্রিম আবেগ ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে বিপশ সম্বন্ধে একথা বিলাসী ধনী ব্যক্তিরাই তাদের বসার ঘরে বসে আলোচনা করত। শহরের সাধারণ মানুষ বিশপের দয়া-মমতার জন্য সত্যিই গভীরভাবে শ্রদ্ধা করত তাঁকে।
ফাঁসির যন্ত্র হিসেবে গিলোটিন প্রচলিত হতে ব্যক্তিগতভাবে বিশপ একটা জোর আঘাত পান মনে। এ আঘাতটা কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছিল তার।
সাধারণত যখন নতুন করে কোনও বধ্যভূমি নির্মাণ করা হয় তখন এক গভীর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় মানুষের মনে। তবে গিলোটিন বস্তুটি নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত মানুষের মৃত্যুদণ্ড নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতাম না আমরা। কিন্তু গিলোটিন দেখার পর হতে মৃত্যুদণ্ডের সপক্ষে বা বিপক্ষে আপন আপন মত প্রকাশ করতে শুরু করেছে সব মানুষ। জোসেফ দ্য মেন্তার মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করেন। কিন্তু সিজার দ্য বেকারিয়া মৃত্যুদণ্ডকে এক জঘন্য ব্যাপার বলে অভিহিত করেন। গিলোটিনকে অনেকে মানুষের অপরাধ সম্বন্ধে আইনের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি হিসেবে গণ্য করলেও আসলে তা হল প্রতিহিংসার মূর্ত প্রতীক। তা কখনই নিরপেক্ষ হতে পারে না অথবা আমাদের নিরপেক্ষ থাকতে দিতে পারে না। যারা এই গিলোটিনকে দেখে নিজের চোখে, তারা ভয়ে হতবুদ্ধি হয়ে যায়, শিউরে ওঠে। গিলোটিনের ওই ধারালো খড়গের আঘাতে সব সামাজিক সমস্যা যেন এক শেষ পরিণতি লাভ করে। গিলোটিন লোহা, কাঠ আর দড়ি দিয়ে গড়া যেন এক নিষ্প্রাণ যন্ত্রমাত্র নয়, এটি যেন এক অবাধ অনিবারণীয় ইচ্ছার ভাবমূর্তি যে সব সময় তার কুটিল উদ্দেশ্যগুলো সাধন করে চলেছে একের পর এক করে। এ যন্ত্রের প্রতিটি অঙ্গ ও অংশ যেন মানুষের সব কথা শুনতে পায়, যেন বুঝতে পারে, দেখতে পায় সব কিছু। ঘাতকের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই গিলোটিন যেন মৃত মানুষের মাংস গ্রাস করে, তার রক্ত পান করে। এটি যেন বিচারক আর যন্ত্রনির্মাতার হাতে গড়া এক রাক্ষস, যে রাক্ষস সাক্ষাৎ মৃত্যুর ভেতর থেকে তার নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে নিজের প্রাণবস্তু আহরণ করে এক ভয়ঙ্কর জীবন যাপন করে চলে।