বিশপ মিরিয়েলের গ্রামাঞ্চলে জন্ম হওয়ায় তিনি গাঁয়ের মানুষের কথা বুঝতে পারতেন। মিদি, ডফিনে, ল্যাঙ্গুয়েদক প্রভৃতি আল্পসের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের গ্রামবাসীদের ভালো বুঝতে পারতেন বলে তারা তাকে তাদের কাছের মানুষ বলে ভাবত। তিনি বড় বাড়িতে ও কুঁড়েঘরে সব জায়গায় সহজভাবে থাকতে পারতেন ও সকল শ্রেণির লোকের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারতেন। তিনি অনেক গুরুগম্ভীর কঠিন বিষয়কে সহজ সরল ভাষায় স্বল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিতদের বুঝিয়ে দিতে পারতেন। তাদের ভাষা বলতে ও বুঝতে পারায় তাদের অন্তরে সহজেই পথ করে প্রবেশ করতে পারতেন। শৌখিন ধনী অথবা সাধারণ লোক সকলকেই সমান জ্ঞান করতেন তিনি। তিনি তাড়াহুড়ো করে কোনও কিছু বিচার করতেন না। আনুপূর্বিক সমস্ত অবস্থা খুঁটিয়ে না দেখে কোনও বিষয়ে মন্তব্য করতেন না। কারও কোনও শোকের কথা শুনলে তিনি প্রথমেই বলতেন, আগে আমাকে দেখতে দাও, শোকটার উদ্ভব কী করে হল। তিনি নিজে অতীতে একদিন পাপ করায় পাপ সম্বন্ধে তাঁর নীতিটি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করার জন্য কোনও ভূমিকা না করেই বলতেন, মানুষের দেহের মাংস একই সঙ্গে তার বোঝা আর প্রলোভনের বস্তু। এই প্রলোভন সম্পর্কে সতর্ক থেকে তার লোভকে সংযত করে বলতে হবে। একমাত্র যখন কোনও মতেই তা সম্ভব নয় তখনই সে দেহের দাবি মেনে চলবে। এই দাবি মেনে চলার ব্যাপাটা শোকের হতে পারে, কিন্তু সে শোক তুচ্ছ। এতে মানুষের যে পতন হয় তা সম্পূর্ণ পতন নয়, এ পতন তার হাঁটুর কাছে এসে থেমে যায় অর্থাৎ সে নতজানু হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেই শোক থেকে মুক্ত হয় সে। সাধু হওয়াটা অবশ্য একটা ব্যতিক্রম, সবাই তা পারে না, কিন্তু সবাই ইচ্ছা করলেই সত্যবাদী হতে পারে। ভুল করো, দোষ করো, পাপ করো, কিন্তু সত্যবাদী হও, খাড়াখাড়ি ব্যবহার, অকপট সরলতার সঙ্গে তা প্রকাশ করো। যতদূর সম্ভব কম পাপ করাটাই হল মানবজগতের নীতি। কিন্তু একেবারে পাপ না করাটা দেবদূতদেরও স্বপ্নের বস্তু। সকল পার্থিব বস্তুই পাপের অধীন, যেন কোনও মাধ্যাকর্ষণজাত শক্তি তাদের পাপের দিকে টানতে থাকে।
কারও কোনও দোষ সম্বন্ধে মানুষের কোনও অবিবেচনাপ্রসূত ঘৃণা বা ক্রোধের অভিব্যক্তি দেখে তিনি হেসে বললেন, এ দোষ তো সকলেই করে। যারা ভণ্ড তারাই সে দোষ বা অপরাধ গোপন করে রাখতে চায়।
সামাজিক শাসনের দ্বারা প্রপীড়িত নারী ও শিশুদের প্রতি তিনি ছিলেন বিশেষভাবে সহানুভূতিশীল। তিনি বলতেন, নারী, শিশু, ভৃত্য, দরিদ্র, দুর্বল এবং অজ্ঞ ব্যক্তিদের অপরাধ বা কোনও পাপ হল আসলে স্বামী, পিতা, প্রভু, ধনী ও বলবানদেরই পাপ।
তিনি আরও বলতেন, অজ্ঞ ও অশিক্ষিতদের শিক্ষা দান করো যতদূর সম্ভব। সকলকে অবৈতনিক শিক্ষা দান না করার জন্য সমাজকেই দোষী সাব্যস্ত করতে হবে। সাধারণ মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখার জন্য সমাজই দায়ী। এ অন্ধকার সমাজেরই সৃষ্টি। অন্ধকারাচ্ছন্ন আত্মাই পাপ করে। কিন্তু প্রকৃত পাপী হল সে-ই যে সে অন্ধকার সৃষ্টি করে।
এইভাবে আমরা দেখতে পাই জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বিশপ মিরিয়েলের এক স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। আমার মনে হয় এ দৃষ্টিভঙ্গি তিনি লাভ করেন বাইবেলের উপদেশামৃত থেকে।
একদিন বিশপ যখন তাঁর বৈঠকখানা ঘরে বসে ছিলেন তখন কোনও এক লোকের অপরাধ সম্বন্ধে আলোচনা হচ্ছিল। এই অপরাধের কথাটা তখন শহরের সকলের মুখে মুখে আলোচিত হচ্ছিল। সেই অপরাধের জন্য অপরাধী অভিযুক্ত হয়েছিল আদালতে এবং অল্প দিনের মধ্যে সে বিচারের রায় বার হবে। অপরাধী লোকটি একটি মেয়েকে ভালোবাসত। তাদের একটি সন্তান হয়। লোকটির সঞ্চিত অর্থ সব ফুরিয়ে যাওয়ায় সে দারুণ অভাবে পড়ে এবং সেই অভাবমোচনের জন্য জাল নোটের কারবার করে। সেকালে জাল নোট ছাপার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। সেই লোকটার তৈরি প্রথম জাল মুদ্রাটি এক জায়গায় চালাতে গেলে মেয়েটি গ্রেপ্তার হয়। মেয়েটিকে আটক করা হলে সে কোথায় কার কাছ থেকে সে মুদ্রা পেয়েছে, সে কথা প্রকাশ করল না। তার হাতে সেই মুদ্রা ছাড়া আর কোনও তথ্য বা প্রমাণ পাওয়া গেল না। সে ইচ্ছা করলেই তার প্রেমিককে ধরিয়ে দিতে পারত এবং তার ধ্বংস ডেকে আনতে পারত। কিন্তু কোনও কথাই বলল না সে এবং এ বিষয়ে জেদ ধরে রইল। তখন সরকারপক্ষের উকিল এক ফন্দি আঁটল মেয়েটির কাছ থেকে আসল কথা বার করার জন্য। কতকগুলি জাল চিঠি বার করে সরকারপক্ষের উকিল মেয়েটিকে বলল, তার প্রেমিক অন্য এক মেয়েকে ভালোবাসে এবং তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। মেয়েটি সে কথা বিশ্বাস করে তার প্রেমিকের ওপর রেগে যায়। তখন সে ঈর্ষা ও প্রতিশোধ বাসনার বশবর্তী হয়ে সব কথা ফাঁস করে দিয়ে তার প্রেমিককে ধরিয়ে দেয়। দু জনেরই বিচার হবে আদালতে এবং লোকটির জেল অথবা ফাঁসি হবে। সরকারি উকিলের বুদ্ধি ও কৌশলের কথা উল্লেখ করে শহরের সব লোক উল্লসিত হয়ে উঠতে লাগল। এই উকিল ভদ্রলোক মেয়েটির ঈর্ষাকাতরতা এবং প্রতিশোধপ্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে আসল সত্যকে প্রকাশ করে ন্যায়ের মর্যাদা রক্ষা করে।
সব কিছু নীরবে শোনার পর বিশপ বললেন, ওদের বিচার কোথায় হবে?