ম্যাগলোরি সব সময় মিরিয়েলকে ‘হে মহান বিশপ’ বলে সম্বোধন করত। একদিন বিশপ তার পড়ার ঘরে একটি আর্মচেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন। সহসা তার অন্য একটি বইয়ের দরকার হয়। কিন্তু বইটা সবচেয়ে উপরের তাকে থাকায় তিনি উঠে গিয়ে হাত বাড়িয়ে তাকটা নাগাল পেলেন না, কারণ তিনি বেঁটেখাটো ছিলেন। তাই তিনি ম্যাগলোরিকে বললেন, ম্যাগলোরি, দয়া করে একটা চেয়ার এনে দেবে? তার উপর দাঁড়িয়ে বইটা পাড়ব। তুমি আমাকে মহান বললেও আমার মাথাটা ওই তাকটার মতো উঁচু নয়।
কোঁতেসি দ্য লো নামে বিশপ মিরিয়েলের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় ছিল। কোঁতেসি প্রায়ই বিশপের কাছে এসে তার তিন ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করত। সুযোগ পেলেই বিশপের কাছে এসে সে শুধু তার ছেলেদের কথা তুলত। কোঁতেসির কয়েকজন ধনী বৃদ্ধ আত্মীয় ছিল যাদের মৃত্যুর পর তার ছেলেরা তাদের সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে। তার ছোট ছেলে তার বাবার এবং কাকার মৃত্যুর পর তার সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে; মেজ ছেলে তার কাকার সব সম্পত্তি পাবে পোষ্যপুত্র হিসেবে আর বড় ছেলে একজন লর্ডের সব বিষয়সম্পত্তি পাবে উত্তরাধিকারী হিসেবে। মিরিয়েল সাধারণত কোঁতেসির এইসব কথা দিনের পর দিন ধৈর্য ধরে শুনে যেতেন। আপন সন্তানদের ভবিষ্যতের আশায় উদ্দীপিত কোনও এক মায়ের নির্দোষ আবেগের সুরে বলা কথাগুলো একঘেয়ে হলেও সহ্য করে যেতেন তিনি। কিন্তু সেদিন অন্যমনা হয়ে কী ভাবছিলেন মিরিয়েল। কোঁতেসি তাই মৃদু রাগের সুরে বলল, কী যে ভাবছ তা ঈশ্বরের নামে বলছি বুঝতে পারছি না।
বিশপ বললেন, আমি ভাবছি সেন্ট অগাস্টিনের কথাটা। অগাস্টিন বলতেন, তোমার সব আশা সেই তাঁর হাতে সমর্পণ করো যাঁর কোনও উত্তরাধিকারী নেই।
আর একবার স্থানীয় কোনও এক ভদ্রলোকের মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে বিশপকে এক চিঠি পাঠায় মৃতের আত্মীয়রা। সে চিঠিতে মৃতের যত সব উপাধি আর তার পারিবারিক সম্মানের কথা লেখা ছিল। চিঠিখানা পড়ে মিরিয়েল বললেন, মৃত্যুর পিঠটা কত চওড়া! মৃতের কত সম্মানের বোঝ সে পিঠকে বহন করতে হয়। মানুষ তার গর্ব ও আত্মগরিমার পরিচয় দেওয়ার জন্য সমাধিস্তম্ভকেও মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে।
মাঝে মাঝে কোনও ব্যক্তিবিশেষ সম্পর্কে কিছু হাস্যপরিহাসের কথাও বলতেন বিশপ। একবার যুবকবয়সী এক গ্রাম্য যাজক দিগনে বড় গির্জায় ধর্মীয় প্রচারের কাজে আসে। একদিন দানশীলতা সম্বন্ধে আগেবপূর্ণ এক বক্তৃতা দেয়। ধনীরা যাতে মৃত্যুর পর নরকযন্ত্রণা পরিহার করে স্বর্গলাভ করতে পারে, তার জন্য তাদের মুক্ত হাতে গরিব-দুঃখীদের দান করতে উপদেশ দেয় সেই যুবক যাজক। নরকের বিভীষিকাটা সে ভাষা দিয়ে আবেগের সঙ্গে ফুটিয়ে তোলে। সেই সভায় মঁসিয়ে জেবোরাদ নামে এক কৃপণ ধনী ছিল। সে কাপড়ের ব্যবসা করে অনেক ধন সঞ্চয় করে, কিন্তু গরিবদের কোনও কিছু দান করত না। এই বক্তৃতা শোনার পর মঁসিয়ে জেবোরাদ প্রতি রবিবার উপাসনা শেষে গির্জা থেকে বার হওয়ার সময় ফটকের কাছে যেসব বৃদ্ধা ভিখারিণী ভিড় করে থাকত তাদের একটি করে পয়সা দিত। একথা বিশপ মিরিয়েলের কানে যেতে তিনি মন্তব্য করলেন তার বোনের কাছে, মঁসিয়ে জেবোরাদ এক পয়সার বিনিময়ে যতটুকু স্বর্গ পাওয়া যায় তাই কিনছেন।
ধনীদের কাছে দান চাওয়ার সময় অনেকে তাঁর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করত। তবু তাতে দমে যেতেন না বিশপ। একবার এক ধনী কৃপণ প্রকৃতির মানুষকে গরিবদের কিছু দান করতে বলেন মিরিয়েল। মাকুঁই-এর কাঁধের উপর হাত রেখে তিনি বলেন, আমাকে কিছু দান করুন মার্কুই।
মার্কুই যখন সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলেন, আমার নিজের অনেক গরিব আত্মীয় আছে বাড়িতে।
বিশপ তখন উত্তর করেন, ঠিক আছে, আপনার সেই গরিবদের আমার হাতে তুলে দিন।
একদিন গির্জার উপদেশ দানের সময় এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ফ্রান্সে কুড়ি হাজার তিনশো কৃষকের বাড়িতে একটা করে দরজা আর দুটো করে জানালা আছে প্রতি ঘরে। আঠারো হাজার আটশো বাড়িতে একটা করে জানালা আছে আর একটা করে দরজা আছে। আর ছেচল্লিশ হাজার তিনশো বাড়িতে প্রতি ঘরে একটা করে মাত্র দরজা আছে। প্রতি দরজা ও জানালা পিছু কর ধার্য থাকার জন্যই এই জানালা-দরজার সংখ্যার এই রকম তারতম্য দেখা যায়। ঈশ্বর বাতাস দান করেছেন, কিন্তু মানুষের আইন সেই বাতাস কেনাবেচা করছে, তা নিয়ে ব্যবসা করছে। আমি আইনকে আক্রমণ করছি না বা দোষ দিচ্ছি না, আমি শুধু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। ঈসেয়ার, ভার প্রভৃতি আল্পস পর্বতের নিম্নাঞ্চলে কৃষক অধিবাসীরা এমনই গরিব যে তাদের ময়লা ফেলার গাড়ি নেই, পিঠে করে তারা ময়লা ফেলে। রাত্রিতে জ্বালার মতো বাতি নেই। তারা শুকনো ডালপালা আর রেড়ির তেলে ভেজা সলতে পুড়িয়ে অন্ধকার দূর করে। ডফিনে প্রভৃতি উত্তরাঞ্চলে রুটি তৈরি করতে পারের না বছরের সব সময়। তারা ছয় মাস ঘুঁটের জ্বালে রুটি তৈরি করে রেখে দেয়। পরে ছয় মাস দারুণ শক্ত হয়ে যাওয়া সেই রুটিগুলো ধারালো দা দিয়ে কেটে চব্বিশ ঘণ্টা জলে ভিজিয়ে রেখে তবে খায়। সুতরাং হে আমার প্রিয় ভাইসব, দয়া করো, তোমাদের চারপাশে যারা আছে তাদের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি সহানুভূতিশীল হও।