মিরিয়েল তখন শহরের সমবেত জনগণের উদ্দেশে বলেন, ভদ্রমহোদয়গণ, আমি বুঝতে পেরেছি, কেন আপনারা আশ্চর্য হয়েছেন। আপনারা ভাবছেন, আমার মতো সামান্য এক যাজক কেন যিশু খ্রিস্টের মতো গাধার পিঠে চড়ে এসেছে এবং ওটা তার অহঙ্কারের পরিচায়ক। কিন্তু আমি আপনাদের জানিয়ে দিচ্ছি, এ কাজ আমি অভাবের বশবর্তী হয়েই করেছি, অহঙ্কারের বশে নয়।
এইভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে শান্ত ও সহজভাবে কথাবার্তা বলতেন মিরিয়েল। প্রথাগত ধর্মীয় প্রচার বা বক্তৃতার পরিবর্তে সরলভাবে কথাবার্তার মধ্য দিয়ে জনগণকে শিক্ষা দিতেন। এমন কোনও গুণানুশীলনের কথা তিনি বলতেন না, যা সাধারণ মানুষের ক্ষমতার বাইরে।
এমন কোনও যুক্তি বা দৃষ্টান্তের উল্লেখ করতেন না, যা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে না। কোনও অঞ্চলের অধিবাসীর গরিবদের সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করলে তিনি প্রতিবেশীদের দৃষ্টান্ত দিয়ে তাদের বোঝাবার বা শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। ব্রিয়ানকলের লোকদের কথা একবার ভেবে দেখ। তার গরিব, নিঃস্ব ও বিধবাদের আর সকলের থেকে তিনদিন আগে খড় কেটে নেওয়ার সুযোগ দেয়। গরিবদের ঘরবাড়ি ভেঙে গেলে গাঁয়ের সঙ্গতিসম্পন্ন লোকেরা বিনা পয়সায় তাদের ভাঙা ঘর মেরামত করে দেয়। এইভাবে সেখানকার লোকেরা সুখে-শান্তিতে বাস করছে। তিনশো বছরের মধ্যে সেখানে কোনও খুন হয়নি।
যেসব গাঁয়ের লোকে নিজেদের ফসল লাভের ব্যাপারটাকেই বড় করে দেখত তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য মিরিয়েল বলতেন, এমব্রামের অধিবাসীদের কথাটা একবার ভেবে দেখ তো। যেসব বাড়ির মালিক একা অর্থাৎ যাদের ছেলেরা সৈন্যবিভাগে কাজ করে এবং মেয়েরা শহরে চাকরি করে, ফসল কাটার সময় গায়ের লোকেরা সেইসব বাড়ির কর্তাদের সাহায্য করার জন্য নিজেরা তাদের ফসল কেটে দেয়। গায়ের কোনও লোক রুগ্ণ বা পঙ্গু হয়ে পড়লে অন্য সব লোকে তাকে সাহায্য করে এবং তার ফসল কেটে সব শস্য তার ঘরে এনে দেয়।
কোনও গায়ের কোনও পরিবারের উত্তরাধিকারের ব্যাপারে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ উপস্থিত হলে বিশপ তাদের বলতেন, একবার দোভোলির পার্বত্য অধিবাসীদের কথা ভেবে দেখ দেখি, ওই অঞ্চলটায় বারো মাসই শীত; বসন্ত আসে না কখনও। প্রায় পঞ্চাশ বছরের মধ্যে একটিবারের জন্যও কোনও নাইটিঙ্গেল পাখি ডাকেনি কখনও। সে গাঁয়ে এক ব্যক্তি মারা গেলে তার ছেলেরা সব পৈতৃক সম্পত্তি বোনদের বিয়ের জন্য রেখে শহরে চাকরি খুঁজতে যায়।
কোনও গাঁয়ের কৃষকরা মামলা-মোকদ্দমায় অনেক খরচপত্র করলে মিরিয়েল তাদের বলেন, একবার কেরাম উপত্যকার অধিবাসীদের কথা ভেবে দেখ। সেখানে তিন হাজার কৃষক বাস করে। যেন একটি ছোটখাটো প্রজাতন্ত্র, তাদের কোনও আদালত বা বিচারক নেই। সেখানে মেয়র সব কিছু করেন। তিনি অধিবাসীদের অবস্থা ও আয় অনুসারে কর ধার্য করেন, কর আদায় করেন, ঝগড়া-বিবাদ মিটিয়ে দেন, উত্তরাধিকারের সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করে দেন। বিভিন্ন অভিযোগের বিচার করেন, কিন্তু কারও কাছ থেকে কোনও পয়সা নেন না। তিনি ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি বলে সকলেই তাঁর কথা মেনে চলে।
কোনও গাঁয়ে কোনও স্কুলমাস্টার না থাকলেও বিশপ কেরাম উপত্যকার কথা উল্লেখ করেন। বলেন, ওখানকার অধিবাসীরা কী করে জান? যেসব ছোট ছোট গাঁয়ে মাত্র দশ-পনেরোটা পরিবার বাস করে, যেসব গাঁ একটা স্কুল চালাতে পারে না বা কোনও মাস্টার রাখতে পারে না, সেইসব গায়ের জন্য কেরাম উপত্যকার অধিবাসীরা নিজেরা চাঁদা তুলে কয়েকজন ভ্রাম্যমাণ শিক্ষক নিয়োগ করে। সেইসব শিক্ষক এক একটি গাঁয়ে গিয়ে এক এক সপ্তাহ করে কাটিয়ে সেইসব গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের বিনা বেতনে লেখাপড়া শেখায়। এইসব ভ্রাম্যমাণ শিক্ষক গ্রাম্য মেলাগুলোতেও যায়, আমি নিজে তা দেখেছি। যেসব শিক্ষক শুধু পড়তে শেখায় তাদের মাথার টুপিতে একটা করে কলম গোঁজা থাকে, যারা পড়তে এবং অঙ্ক কষতে শেখায় তাদের দুটো কলম আর যারা পড়তে, অঙ্ক কষতে আর লাতিন ভাষা শেখায় তাদের তিনটে করে কলম থাকে। তবে এই শেষোক্ত শিক্ষকরাই বেশি জ্ঞানী। কিন্তু অজ্ঞতা বা নিরক্ষরতা সত্যিই বড় লজ্জাজনক ব্যাপার। কেরাম উপত্যকার লোকদের মতো তোমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
এমনি করে গম্ভীরভাবে কথা বলে গ্রামবাসীদের শিক্ষা দিতেন বিশপ মিরিয়েল। যখন হাতের কাছে কোনও বাস্তব দৃষ্টান্ত খুঁজে পেতেন না তখন বাইবেল থেকে যিশুর কোনও কথামৃত তুলে ধরতেন। কোনও গুরুগম্ভীর শব্দ ব্যবহার না করে অল্প কথায় মূল শিক্ষণীয় বিষয়টি তুলে ধরতেন। বাগ্মিতা হিসেবে যিশুর কথকতার রীতি অবলম্বন করতেন। তিনি যখন কিছু বলতেন তখন অনুপ্রাণিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তা বলতেন। অন্তরের গম্ভীর হতে উৎসারিত সেসব কথা সহজেই অনুপ্রাণিত করে তুলত শ্রোতাদের।
.
৪
বিশপ মিরিয়েলের সব আলাপ-আলোচনার স্রোত হালকা আর সরস সুরে এক বন্ধুত্বপূর্ণ আবহাওয়ায় প্রবাহিত হত। যে দু জন নারী অর্থাৎ তার বোন বাপতিস্তিনে আর ম্যাগলোরি তাঁর চিরজীবনের সাথি ছিল, তিনি তাদের থেকে কখনও বড় ভাবতেন না নিজেকে। তিনি নিজেকে তাদের স্তরের মানুষ হিসেবেই ভাবতেন। যখন তিনি কথা বলতে বলতে কোনও কারণে হাসতেন তখন মনে হত তিনি যেন কোনও সরলমতি বালক।