এই আয়ের মধ্যেই তাদের অতিথিদের আপ্যায়ন করতে হত। দিগনের গির্জায় যখন কোনও গ্রাম্য যাজক যোগদান করতে আসতেন বিশপের সঙ্গে তখন তারা সাধ্যমতো খরচ করে আদর-আপ্যায়ন করতেন।
দিগনেতে আসার তিন মাস পরে বিশপ একদিন বাড়িতে বললেন, এখনও আমার অর্থের টানাটানি চলছে।
ম্যাগলোরি বলল, আমারও তাই মনে হয়। মঁসিয়ে সরকারের কাছে আপনার ভ্রমণকার্যের জন্য যানবাহন খরচ বাবদ কিছু অর্থের জন্য আবেদন করতে পারেন।
বিশপ বললেন, ঠিক বলেছ ম্যাগলোরি।
সত্যি সত্যিই সরকারের কাছে আবেদন জানালেন বিশপ। কিছুদিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে বিশপের যানবাহন ও ডাকখরচের জন্য বাৎসরিক তিন হাজার ফ্ৰাঁ মঞ্জুর করলেন।
এই অর্থ মঞ্জুরির ব্যাপারটা শহরের বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে এক আলোড়ন সৃষ্টি করল। এক চাপা প্রতিবাদের গুঞ্জনধ্বনি শোনা যেতে লাগল অনেক জায়গায়। সম্রাটের কাউন্সিলার একজন সিনেটার মন্ত্রীর কাছে এর প্রতিবাদ জানিয়ে এক চিঠি লিখলেন। তিনি লিখলেন, যানবাহন খরচ? যে শহরে চার হাজারেরও কম লোক বাস করে সেখানে আবার যানবাহন খরচ কিসের? ডাকখরচ আর গ্রামযাত্রাই-বা কিসের? গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াবারই-বা কী দরকার? পার্বত্য অঞ্চলে যেখানে কোনও রাস্তাঘাট বা যাতায়াত ব্যবস্থা নেই সেখানে গাড়িতে করে নিয়মিত চিঠি বিলি করার কীই-বা প্রয়োজন? লোকে ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াত করে। শাতো আর্নোতে দুরান্স নদীর উপর যে সেতু আছে তা বোধ হয় গরুর গাড়ির ভার সহ্য করতে পারবে না। সব যাজকই এক প্রকৃতির লোভী ও কৃপণ। এই বিশপটি প্রথম প্রথম কিছু গুণের পরিচয় দিয়ে এখন আবার আর পাঁচজন সাধারণ যাজকের মতই নিজমূর্তি ধারণ করেছে। তাঁর আবার গাড়ি চাই, যানবাহনের। ব্যবস্থা চাই। আগেকার আমলের বিশপরা যেসব বিলাসব্যসন ভোগ করতেন ইনিও তাই চান। এইসব যাজক দ্বারা কোনও কাজই হবে না।
ম্যাগলোরি কিন্তু অর্থ মঞ্জুরির কথাটা জানতে পেরে খুশি হল। সে একদিন বাপতিস্তিনেকে বলল, মঁসিয়ে প্রথমে পরের কথা খুব ভাবতেন, এখন তাকে নিজের কথা কিছু ভাবতে হচ্ছে। তিনি দানের কাজে সব অর্থ খরচ করে ফেলেছেন। এখন এই তিন হাজার ফ্রাঁ আমাদের হাতে থাকবে।
কিন্তু সেইদিন সন্ধ্যাতেই কিভাবে ওই তিন হাজার ফ্রাঁ খরচ করবেন তার একটা খসড়া তৈরি করে তার বোনের হাতে দিয়ে দিলেন বিশপ।
এছাড়া চার্চের ধর্মীয় ব্যাপারে ও দানের কাজে আরও যেসব খরচ হত সে খরচের অর্থ তিনি ধনীদের কাছ থেকে চাঁদা হিসেবে আদায় করতেন। ধনীদের কাছ থেকে অনেক সময় চাঁদা তুলে গরিবদের দান করতেন। যেসব ধনীর কাছে চাঁদা বা ভিক্ষা চাইতে যেতেন না মিরিয়েল, তারাও তার নামে দানের টাকা পাঠিয়ে দিতেন। এইভাবে অনেকেই সাহায্য করত। এক বছরের মধ্যেই দানের ব্যাপারে মোটা অঙ্কের অর্থ এসে জমল বিশপ মিরিয়েলের হাতে। কিন্তু এত সব টাকা হাতে আসা সত্ত্বেও মিরিয়েলের জীবনযাত্রার কোনও পরিবর্তন হল না। দানের জন্য জমা টাকা থেকে একটা পয়সাও ব্যক্তিগত ব্যাপারে খরচ করতেন না তিনি। তাছাড়া হাতে টাকা আসতে না আসতেই তা গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন মিরিয়েল। দানের থেকে দারিদ্র্য ও অভাব সব সময়ই অনেক বেশি বলে মাঝে মাঝে টাকার টানাটানি হত। তখন তাঁকে ব্যক্তিগত সংসারের খরচের টাকা থেকে সে টাকার অভাব পূরণ করতে হত।
তখনকার দিনের একটি প্রথা ছিল : বিশপরা যখন গ্রামাঞ্চলে তাঁদের কোনও চিঠি বা নির্দেশপত্র পাঠাতেন তখন সেই সঙ্গে তাঁদের খ্রিস্টীয় নামগুলো ও ডাকনামগুলোর একটি তালিকা দিতে হত তাঁদের। সেইসব নাম থেকে যে নামটি সবচেয়ে অর্থপূর্ণ মনে হত গ্রামবাসীদের, বিশপকে তারা সেই নামে ডাকত। বিশপ মিরিয়েলকেও তার এলাকার গ্রামবাসীরা ‘বিয়েনভেনু’ এই নামে ডাকত। ‘বিয়েনভেনু’ কথাটির অর্থ হল স্বাগত।
আমরা বিশপ মিরিয়েলের যে জীবন-চিত্র আঁকতে চলেছি তা হুবহু সত্য না হলেও তার সঙ্গে তাঁর জীবনের অনেক মিল আছে।
.
৩
বিশপ যদিও যানবাহন খরচের টাকাটা গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন তবু গ্রাম পরিক্রমার বা পরিদর্শনের কাজে কোনওরূপ অবহেলা করতেন না তিনি। দিগনে অঞ্চলটা ছিল পাহাড়-পর্বতে ঘেরা এবং তার ভূমিপ্রকৃতি ছিল বন্ধুর। সমতল জায়গা খুব কমই ছিল। দিগনের অধীনস্থ এলাকার মধ্যে ছিল বত্রিশটা গ্রাম্য গির্জা, একচল্লিশটা ছোট গির্জা আর দুশো পঁচিশটা ব্যক্তিগত গৃহসংলগ্ন উপাসনাকেন্দ্র। এই সমস্ত গির্জা আর উপাসনাকেন্দ্র ঘুরে বেড়িয়ে দেখা কোনও লোকের পক্ষে সত্যিই এক কষ্টকর ব্যাপার। কিন্তু বিশপ মিরিয়েল শত কষ্টকর হলেও তা করতেন। তিনি নিকটবর্তী গ্রামগুলো পায়ে হেঁটে যেতেন, সমতল জায়গাগুলো মালবাহী গাড়িতে এবং পার্বত্য এলাকাগুলো ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া-আসা করতেন। তাঁর বোন ও ম্যাগলোরিও প্রায়ই তাঁর সঙ্গে যেতেন। তবে যেসব জায়গায় পথ খুবই দুর্গম সেখানে বিশপ একাই যেতেন।
একদিন সিনেজ নামে একটি ছোট শহরে যান বিশপ মিরিয়েল। সেখানে যাজকদের এক সরকারি অফিস ছিল। তিনি সেখানে একটি গাধার পিঠে চেপে যান। তাঁর হাতে তখন পয়সা বেশি না থাকায় অন্য কোনও যানবাহনের ব্যবস্থা করতে পারেননি। তাঁকে গাধার পিঠে শহর ঘুরতে দেখে মেয়র তাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসে আশ্চর্য হয়ে যায়। শহরের লোকরা হাসাহাসি করতে থাকে।