বিশপ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দিগনেতে আসার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি বিধান অনুসারে প্রচুর সম্মান পেতে থাকেন মিরিয়েল। পদমর্যাদার দিক থেকে তিনি ছিলেন ফ্রান্সের সেনানায়কের নিচেই। তিনি দিগনেতে আসার পর যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি তার সঙ্গে দেখা করেন তারা হলেন মেয়র আর কাউনসিলার প্রেসিডেন্ট। আর তিনি যাদের সঙ্গে দেখা করেন তাঁরা হলেন প্রধান সেনাপতি আর পুলিশ বিভাগের প্রধান।
তিনি বিশপ পদ গ্রহণ করার পর থেকে তার কাজকর্ম দেখার জন্য উৎসুক হয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগল শহরের লোকেরা।
.
২
দিগনেতে বিশপের প্রাসাদোপম বাড়িটি ছিল হাসপাতালের পাশেই। আগাগোড়া পাথর দিয়ে গড়া প্রাসাদটি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের ডক্টর পুগেৎ আর দিগনের তদানীন্তন বিশপ সিমুরের অ্যাবটের দ্বারা নির্মিত হয় ১৭১২ সালে। আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যের সব রকম ব্যবস্থাই ছিল প্রাসাদের মধ্যে। সেখানে ছিল বিশপের নিজস্ব কামরা, বসার ঘর, শোবার ঘর আর সামনের দিকে ছিল বিস্তৃত এক উঠোন। উঠোনের চারদিকে ছিল ফুল ও ফলের সুন্দর সুন্দর গাছে ভরা এক বাগান। বাগানের কাছে একতলায় খাবার ঘরটি ছিল যেমন বড় আর তেমনি সুন্দরভাবে সাজানো। ১৭১৪ সালে মঁসিয়ে পুগেৎ এই খাবার ঘরেই কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে এক ভোজসভায় আপ্যায়িত করেন। সেইসব ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন ফিলিপ দ্য ভেঁসেম, গ্রাদ প্রিয়র অব ফ্রান্স, চতুর্থ হেনরির প্রপৌত্র আর গ্যাব্রিয়েল দেস্ত্রি। সাতজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তির পূর্ণাবয়ব চিত্র এই ঘরের দেয়ালে টাঙানো ছিল এবং চিত্রগুলোর তলায় মর্মরপ্রস্তরের উপরে সোনার অক্ষরে লেখা ছিল ওই ব্যক্তিদের পরিচয়লিপি।
হাসপাতালের বাড়িটি ছিল দোতলা এবং তার সামনেও একটি বাগান ছিল। তবে বাড়িটা খুব একটা বড়সড় ছিল না।
দিগনেতে আসার পর তৃতীয় দিনে হাসপাতালটা দেখতে যান বিশপ মিরিয়েল। দেখার পর হাসপাতালের ডিরেক্টরকে তার প্রাসাদে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।
খাবার ঘরে বসে ডিরেক্টরকে প্রশ্ন করেন মিরিয়েল, কতজন রোগী আছে হাসপাতালে।
পঁচিশজন মঁসিয়ে।
রোগীর সংখ্যা তো দেখছি অনেক।
রোগীদের বিছানা ও খাটগুলো গাঁয়ে গায়ে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে স্থানাভাবে।
তা তো দেখছি। ওয়ার্ডগুলো এক একটি ছোট ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাতে আলো-বাতাস খেলে না।
হ্যাঁ। ব্যাপারটা তাই।
আবহাওয়াটা উজ্জ্বল থাকলেও একটু সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীদের বাগানে বসার জায়গা থাকে না।
আমারও তাই মনে হয়।
আর কোনও মহামারী দেখা দিলে যেমন এ বছর টাইফাস রোগ মহামারীর আকার ধারণ করে এবং বছর দুই আগে এক মারাত্মক সামরিক জ্বর দেখা দিলে একশো জন রোগীকে সামলাতে হয় আমাদের এই হাসপাতালে। তখন কী যে করব, তা বুঝে উঠতে পারি না।
মিরিয়েল বললেন, আমিও সে কথা ভেবেছি। আচ্ছা, এই ঘরটাতে কতগুলো রোগীর বিছানা ধরতে পারে?
ডিরেক্টর আশ্চর্য হয়ে বললেন, বিশপের খাবার ঘরে?
বিশপ ঘরখানার আয়তন ঘুরে দেখে আপন মনে বললেন, অন্তত কুড়িটা বিছানা ধরবে।
এরপর স্পষ্ট করে বললেন, শুনুন মঁসিয়ে ডিরেক্টর, একটা ভুল হয়ে গেছে। আপনাদের পাঁচ-ছ’টা ছোট ঘরে ছাব্বিশটা রোগী থাকে, অথচ আমাদের এই এত বড় বাড়িতে যেখানে ষাটজন লোক থাকতে পারে সেখানে আমরা মাত্র তিনজন থাকি। এমন অবস্থায় আমরা বরং ওই বাড়িতে চলে যাব আর আপনারা এই বাড়িটা হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করবেন।
পরদিনই বিশপের প্রাসাদে ছাব্বিশজন গরিব রোগী চলে এল আর বিশপ চলে গেলেন হাসপাতালের বাড়িতে।
মঁসিয়ে মিরিয়েলের ব্যক্তিগত কোনও সঞ্চয় ছিল না। বিপ্লবে তাঁর পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। তাঁর বোনের বার্ষিক যে পাঁচশো ফ্রাঁ আয় ছিল, গত এক বছরে সেই আয় নানা পারিবারিক প্রয়োজনে খরচ হয়ে যায়। কারণ সামান্য এক গ্রাম্য যাজক থাকাকালে তার আয় খুব কম ছিল। বিশপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাৎসরিক বেতন পনেরো হাজার ফ্রাঁতে দাঁড়ায়। এই টাকা থেকে সারা বছরে ব্যক্তিগত খরচ হিসেবে মাত্র এক হাজার ফ্রাঁ রেখে বাকি সব টাকা তার এলাকার মধ্যে নানা ধর্মীয় ও জনহিতকর কাজে ব্যয় করার একটি খসড়া তৈরি করেন। তার থেকে বোঝা যায় তার এলাকায় গরিব-দুঃখীদের দুঃখমোচন, গরিব ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নতি, কারাগারের উন্নতি, দুস্থ পরিবারের রোজগারি বন্দিদের মুক্তি, যত সব গ্রাম্য গির্জার ও যাজকদের উন্নতি প্রভৃতির ব্যাপারে তিনি তার আয়ের প্রায় সবটাই খরচ করতেন।
দিগনের গির্জায় মঁসিয়ে মিরিয়েল আসার পর থেকে তার সংসারের আয়-ব্যয় সম্বন্ধে যে ব্যবস্থা করেন তা তাঁর বোন ম্যাদময়জেল বাপতিস্তিনে অকুণ্ঠভাবে মেনে নিতে বাধ্য হন। বাপতিস্তিনের কাছে মিরিয়েল ছিলেন একাধারে বড় ভাই, মহামান্য বিশপ এবং পরম বন্ধু। মিরিয়েলকে তিনি এতই ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন যে বিশপ যখন কোনও কথা বলতেন বা কাজ করতেন তখন তাঁর বোন মাথা নিচু করে তার সব কথা শুনতেন, তার সব কাজ সমর্থন করতেন। একমাত্র ম্যাগলোরি মাঝে মাঝে ক্ষোভ প্রকাশ করত। বিশপের আয়-ব্যয়ের যে খসড়া পাই তার থেকে জানতে পারি তিনি বাইরে তাঁর ব্যক্তিগত খরচের জন্য মাত্র এক হাজার ফ্রাঁ রেখে দিতেন। তাঁর বোনের পাঁচশো ফ্রাঁ বাৎসরিক আয় ছিল। দু জনের মোট পনেরোশো ফ্রাঁ আয়ে তাদের সংসার চালাতে হত।