১৮১৫ সালে মঁসিয়ে শার্লস ফ্রাঁসোয়া বিয়েনভেনু মিরিয়েল যখন দিগনের বিশপ হন তখন তার বয়স প্রায় পঁচাত্তর। ১৮০৬ সাল থেকে এই বিশপের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি।
যে কাহিনী আমি বলতে যাচ্ছি তার সঙ্গে এই ঘটনার কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকলেও তার বিশপ পদ লাভের সময় তাকে কেন্দ্র করে যেসব গুজব রটে, তার কিছু বিবরণ আমাকে অবশ্যই দিতে হবে। কোনও মানুষ সম্বন্ধে লোকমুখে যেসব গুজব শোনা যায়, তার কীর্তিকলাপের মতো এইসব গুজব বা জনশ্রুতিরও একটা বড় রকমের প্রভাব দেখা যায় তার জীবন ও ভাগ্যে। মঁসিয়ে মিরিয়েল ছিলেন আইকস পার্লামেন্টের কাউনূসেলার ও নোবলেসি দ্য রোব-এর সদস্যের পুত্র। শোনা যায় তার বাবা তার মৃত্যুর পর তাঁর পদে যাতে অধিষ্ঠিত হতে পারে তার জন্য ছেলের অল্প বয়সে অর্থাৎ আঠারো থেকে কুড়ি বছরের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করেন তার। পার্লামেন্টের সদস্যদের পরিবারে এই ধরনের প্রথাই প্রচলিত ছিল সেকালে। কথিত আছে এই বিয়ে সত্ত্বেও শার্লস মিরিয়েলকে কেন্দ্র করে অনেক গুজবের সৃষ্টি হয়। তার চেহারাটা বেঁটেখাটো হলেও তিনি বেশ সুদর্শন ছিলেন। প্রথম যৌবনে তিনি বিয়ে করে সংসারী হন এবং যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করেন।
তার পর ফরাসি বিপ্লব শুরু হতেই পার্লামেন্টের সদস্যদের পরিবারগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং মিরিয়েল দেশ ছেড়ে ইতালিতে চলে যান এবং সেখানে গিয়ে নতুনভাবে বসবাস করতে থাকেন। তাঁর স্ত্রী এই সময় বুকের গোলমালে ভুগে মারা যান। তাঁদের কোনও সন্তানাদি ছিল না। যাই হোক, এই বিপ্লবের পর কী ঘটল মিরিয়েলের জীবনে
তবে কি তার আপন পরিবার ও পুরনো ফরাসি সমাজব্যবস্থায় ব্যাপক ভাঙন, বিদেশ থেকে দেখা দেশের মধ্যে ঘটে যাওয়া ১৭৯৩ সালের মর্মান্তিক ঘটনাবলি এক বৈরাগ্যবাসনা আর নিঃসঙ্গতার প্রতি প্রবণতা জাগিয়ে তোলে? যেসব বিক্ষুব্ধ ঘটনাবলির উত্তাল তরঙ্গমালা তাঁর জীবনের বহিরঙ্গের ওপর আঘাত হেনে চলেছিল ক্রমাগত সেই আঘাত হয়তো তাঁর মধ্যে সঞ্চার করেছিল এক রহস্যময় জীবনবিমুখতা, যা তাঁর স্বভাবটাকে একেবারে পাল্টে দিয়ে পাহাড়ের মতো এমন এক উতুঙ্গ প্রশান্তি দান করে, যার ফলে জীবনের সকল ঝড়ঝঞ্ঝা ও দুঃখবিপর্যয়ের মাঝে অটল ও অবিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু এমন কথা কেউ ঠিকমতো বলতে পারে না। তার সম্বন্ধে শুধু এইটুকুই জানান যায় যে ইতালি থেকে দেশে ফিরে এসেই তিনি যাজকের পদ গ্রহণ করেন।
১৮০৪ সালে মিরিয়েল ব্রিগনোলের পল্লি গির্জার যাজক হন এবং সেখানে এক নির্জন পরিবেশের মধ্যে বসবাস করতে থাকেন।
সম্রাট নেপোলিয়ঁনের রাজ্যাভিষেকের সময় মিরিয়েলকে তাঁর গির্জার কিছু কাজের ব্যাপারে একবার প্যারিসে যেতে হয়। এই সময় যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, সম্রাটের কাকা কার্ডিনাল ফ্রেস্ক তাদের অন্যতম। একদিন তিনি যখন কার্ডিনালের ঘরের বাইরে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তখন সম্রাট নেপোলিয়ঁন তাঁর কাকার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন তার ঘরে। ঘরে যাওয়ার পথে নেপোলিয়ঁন মিরিয়েলকে তাঁর পানে সশ্রদ্ধভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করেন, কে আপনি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন?
মিরিয়েল উত্তর করেন, মহাশয়, আমার মতো একজন অতিসাধারণ ব্যক্তি আপনার মতো এক মহান ব্যক্তির পানে তাকিয়ে আছে। এতে হয়তো আমরা উভয়েই উপকৃত হতে পারি।
সেদিন সন্ধ্যায় ম্রাট নেপোলিয়ঁন কার্ডিনালকে মিরিয়েলের কথা জিগ্যেস করেন। তার কিছু পরেই একথা জানতে পেরে আশ্চর্য হয়ে যান মিরিয়েল যে তিনি দিগনের বিশপ পদে নিযুক্ত হয়েছেন।
মঁসিয়ে মিরিয়েলের বাল্যজীবন সম্বন্ধে কেউ কিছু জানত না বা জোর করে কোনও কিছু বলতে পারত না। ফরাসি বিপ্লবের আগে তাঁর পরিবার সম্বন্ধে যারা সব কিছু জানত তাদের কেউ ছিল না তখন। একটা সামান্য গাঁ থেকে একটা ছোট শহরে আসার পর তাকে নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। অনেকে অনেক কথা বলতে থাকে। কিন্তু পদমর্যাদার খাতিরে সব কিছু সহ্য করে যেতে হয় তাঁকে। তবে তাঁর সম্বন্ধে এইসব চর্চা নিতান্ত অর্থহীন গুজব আর মনগড়া কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়।
যাই হোক, দিগনের বিশপ হিসেবে আসার পর থেকে বছর কয়েকের মধ্যে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়া সব গুজব আর যত সব গল্পকাহিনী স্তব্ধ হয়ে যায়। সেসব কথা ভুলে যায় সকলে। কেউ কোথাও সেসব কথা আর উল্লেখ করত না।
মঁসিয়ে মিরিয়েল যখন দিগনেতে আসেন তখন তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর অবিবাহিত বোন ম্যাদময়জেল বাপতিস্তিনে আর মাদাম ম্যাগলোরি। ম্যাদময়জেল বাপতিস্তিনে ছিল বিশপ মিরিয়েলের থেকে দশ বছরের ছোট আর ম্যালোরি ছিল বাপতিস্তিনের সহচরী দাসী আর সমবয়সী। ঘরসংসারের যাবতীয় কাজকর্ম সব ম্যাগলোরিই করত।
বিগতযৌবনা ম্যাদময়জেল বাপতিস্তিনের চেহারাটা ছিল বরাবরই লম্বা আর রোগা। যৌবনের কোনও সৌন্দর্য ছিল না তার দেহে। কিন্তু চেহারাটা রোগা হলেও তার চোখে-মুখে এমন এক শান্তশ্রী ছিল, যাতে তাকে এক নজরেই একজন সম্ভ্রান্ত মহিলা বলে মনে হত। সততা আর মহানুভবতার যে একটি নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, বাপতিস্তিনে সারাজীবন জনহিতকর কাজ করে আসার জন্য সেই সৌন্দর্যের একটি স্নিগ্ধ জ্যোতি সব সময় আচ্ছন্ন করে থাকত তার মুখমণ্ডলকে। যৌবনে তার যে দেহটি ছিল শীর্ণ ও অস্থিচর্মসার, প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক স্বচ্ছ উজ্জ্বলতার আধার হয়ে ওঠে সেই শীর্ণ দেহটি। তার চেহারা দেখে যৌবনেই মনে হত সে যেন কোনও কুমারী নারী, এক বিদেহী আত্মা, এক অবয়বহীন ছায়া, যে ছায়া থেকে সব সময় বিচ্ছুরিত হতে থাকে এক আশ্চর্য জ্যোতি। তার বড় বড় আয়ত দুটি চোখের দৃষ্টি সব সময় অবনত থাকত মাটির উপর। মনে হত তার আত্মা মাটির পৃথিবীতেই বিচরণ করে বেড়ায় সদাসর্বদা।