কুরফেরাক বলল, এরাই হল আমাদের সব?
না।
আর আমাদের দলের লোক কোথায় আছে?
আছে।
কমবেফারে বলল, তারা কারা?
এঁজোলরাস বলল, ব্যারিয়ের দু মেন।
কিছুক্ষণ নীরবে ভেবে নিয়ে সে আবার বলল, ব্যারিয়ের দু মেনে মর্মরপ্রস্তরের কাজ করে এমন কিছু শ্রমিক আছে। স্টুডিওতে কিছু শিল্পী ও শ্রমিকও আছে। সম্প্রতি তারা উদ্যম হারিয়ে ফেলেছে। তারা শুধু ডোমিনো খেলে সময় কাটায়। তারা কাফে রিশেফুতে বেলা বারোটা থেকে একটার মধ্যে থাকে। আমাদের কেউ গিয়ে তাদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলবে। নিবে আসা ওই সব কাঠগুলোকে ফুঁ দিয়ে আবার জ্বালিয়ে দিতে হবে। সুতরাং সেখানে যাবার মতো একজন কাউকে চাই। সেখানে পাঠাবার মতো কোনও লোক পাচ্ছি না। ভাবুক মেরিয়াস তো এখন এখানে আসেই না।
গ্রান্তেয়ার বলল, একজন আছে। সে হচ্ছে আমি।
তুমি?
কেন নয়?
তুমি প্রজাতন্ত্রের নীতিগুলো ব্যাখ্যা করে লোকদের জাগাবে।
কিন্তু কেন আমি ওখানে যাব না?
তুমি গেলে কি ভালো হবে?
গ্রান্তেয়ার বলল, চেষ্টা করে দেখতে চাই।
তুমি তো এসব কিছু বিশ্বাসই কর না।
তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে।
গ্রান্তোয়ার, তুমি কি সত্যিই আমার কিছু উপকার করতে চাও?
তুমি যা বলবে আমি করব; তোমার জুতোতে কালি পর্যন্ত দিয়ে দেব।
তা হলে আমাদের এ সব কাজ থেকে দূরে থাক।
এটা তোমার অকৃতজ্ঞতার পরিচয় এঁজোলরাস।
তুমি কি সত্যিই সত্যিই মনে কর ব্যারিয়ের দু মেনে যাবার উপযুক্ত লোক তুমি, তুমি এ কাজ করতে পারবে?
আমি ভগিয়ার্দ, এসাস ও র্যু দ্য মঁতপার্নেসি হয়ে কাফে রিশেফুতে যাব।
কাফে রিশেফুতে ওদের চিনতে পারবে?
খুব ভালো একটা চিনি না, তবু কিছুটা বন্ধুভাব আছে।
কী বলবে তাদের?
আমি তাদের রোবোসপিয়ার আর দাঁতনের নাম উল্লেখ করে বিপ্লবের কথা বলল।
তুমি তা পারবে?
হা পারব। আমাকে কেউ বুঝতে পারে না। কোনও একটা কাজে গেলে আমি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠি। আমি প্রুধো ও লা সোশ্যাল কনস্ট্রাক্ট পড়েছি। আমি দ্বিতীয় বর্ষের সংবিধানও পড়েছি। যেখানে নাগরিকদের স্বাধীনতা শেষ হচ্ছে সেখানেই শুরু হচ্ছে নতুন নাগরিক। তুমি কি মনে কর আমি অজ্ঞ? মানুষের অধিকার, জনগণের সার্বভৌমত্ব–আমি সব জানি। আমি কিছুটা হেবার্তিস্তুও। দরকার হলে আমি ছ ঘণ্টা একটানা বসে গভীরভাবে পড়াশোনা করতে পারি।
এঁজোলরাস বলল, গুরুত্ব দিয়ে কথা বল।
হ্যাঁ, গুরুত্ব দিয়েই বলছি।
কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে এঁজোলরাস সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলল। সে গম্ভীরভাবে বলল, ঠিক আছে গ্রান্তেয়ার। আমি তোমাকে পরীক্ষা করব। তুমি ব্যারিয়ের দু মেনে যাবে।
গ্রান্তেয়ার কাফে মুসেঁর কাছাকাছি একটা ভালো ঘরে থাকত। সে তার ঘরে চলে গিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই রোবোসপিয়ার মার্কা একটা ওয়েস্টকোট পরে ফিরে এল। সে এঁজোলরাসের দিকে অপূর্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তাকাবার কোনও কারণ নেই।
এই বলে মাথায় টুপিটা চাপিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
পনেরো মিনিটের মধ্যে কাফে মুর্সের পেছন দিকের ঘরটা খালি হয়ে গেল। এবিসি সংস্থার সব সদস্যরা তাদের আপন আপন কাজে বেরিয়ে গেল। সবশেষে গেল এঁজোলরাস।
প্লেস দ্য ইসির একটা পরিত্যক্ত ঘরে কুগোর্দের সদস্যরা বসত। পথে সব কিছু খুঁটিয়ে ভেবে দেখতে লাগল এঁজোলরাস। সমাজে যখন গোলমাল দেখা দেয় এবং তার প্রতিকারের জন্য কিছু একটা কাজ শুরু করা হয় তখন সামান্য একটা জটিলতাকে এক বিরাট বাধা বলে মনে হয়। এখন বিস্ময়ের কাজ শুরু করা ঠিক হবে না। দিগন্তব্যাপী মেঘমালার ওপার থেকে এক নতুন উজ্জ্বল প্রভাত উঁকি মারছিল এঁজোলরাসের চোখের সামনে। সে ভাবতে লাগল, কে বলতে পারে, অচিরে এমন একদিন আসবে যখন বিপ্লবের বেগবান স্রোতোধারা সমগ্র ফ্রান্সকে পরিপ্লাবিত করে ফেলবে এবং জনগণ তাদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করবে। সে দেখল তার হাতে এমন একদল বন্ধু আছে যারা সারা ফ্রান্সে বক্তৃতা দিয়ে জনগণকে উত্তেজিত করে বেড়াচ্ছে। সেই সব বক্তৃতার মধ্যে আছে কমবেফারের গম্ভীর দার্শনিক বাগিতা, ফুলির বিভিন্ন ভাষার জ্ঞান, কুরফেরাকের অত্যুৎসাহিতা, বাহোরেলের হাস্যরস, জাঁ ভেয়ারের বিষণ্ণ গাম্ভীর্য, জলির পাণ্ডিত্য, বোসেতের শ্লেষাত্মক ভঙ্গি। তাদের এই সব গুণগুলো একযোগে প্রচারের সঙ্গে নিয়োজিত হচ্ছে। কাজ সব ঠিকই চলছে।
এবার হঠাৎ গ্রান্তেয়ারের কথা মনে পড়ে গেল তার। ব্যারিয়ের দু’ মেন বা কাফে রিশেফু এখান থেকে বেশি দূরে নয়। কাফেতে এখন কারা কী করছে সেটা যদি এখন নিজে গিয়ে দেখে আসে তা হলে ক্ষতি কী?
এঁজোলরাস কাফে রিশেফুতে গিয়ে বাইরে থেকে দেখল ঘরের ভেতরে ডোমিনো খেলা চলছে। সমস্ত ঘরটা ধোঁয়ায় ভর্তি। গ্রান্তেয়ার একটা লোকের সঙ্গে কথা বলছিল। তাদের মাঝখানে একটা টেবিল ছিল।
এঁজোলরাস শুনতে পেল গ্রান্তেয়ার টেবিলের উপর একটি ঘুষি মেরে বলল, ছয় ডবল।
অন্য লোকটি বলল, চার।
গ্রান্তেয়ার ডোমিনো খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছে একেবারে।