একদিন একজন লোক বলে, আমাদের অভিযানের পরিকল্পনা সব প্রস্তুত।
আর একদিন একজন বলে, ভদ্রলোককে প্যারিসের রাস্তায় আর বেশিদিন বেড়াতে দেবে না। তার জন্য ওরা উঠে-পড়ে লেগেছে এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।
কিন্তু ভদ্রলোকটি কে? এইটাই হচ্ছে রহস্যময় ব্যাপার।
পয়েন্ত সেন্ট ইউসত্রাশের কাছে এক কাফেতে বিপ্লবের নেতারা জড়ো হত। অগাস্তে নামে এক দর্জি শ্রমিক সংস্থার লোক ফবুর্গের শ্রমিকদের সঙ্গে নেতাদের যোগাযোগ রক্ষা করে চলত। একজনকে বিচারের সময় আদালতে জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমার নাম কী? কে তোমার নেতা? সে তখন উত্তর করে, আমি আমার নেতাকে চিনি না।
একদিন এক কাঠের মিস্ত্রি এক নতুন বাড়ির চারদিকে কাঠের বেড়া দেবার সময় একটা কাগজের চিরকুট পায়। তাতে লেখা ছিল, ফবুর্গ অঞ্চলে র্যু দ্য পাসনিয়েরের একটি বন্দুকের দোকানে পাঁচ-ছ’ হাজার রাইফেল আছে, আমাদের অস্ত্রের বড় দরকার। মিস্ত্রি লোকটি সঙ্গে সঙ্গে তার সহকর্মীদের সেটা দেখায়।
পুলিশ আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে অনেক বাড়ির গোপন জায়গা থেকে অনেকগুলো বন্দুক উদ্ধার করে। এদিকে বিপ্লবী শ্রমিকরাও অনেকগুলো বন্দুকের দোকান থেকে অনেক অস্ত্র চুরি করে আনে। ব্যারিয়ের সাবেস্তন কাফের বাইরে গলিপথে দাঁড়িয়ে প্রায় রোজ একজন শ্রমিক দিনের কাজ থেকে এসে আর একজন শ্রমিকের হাতে একটা করে পিস্তল তুলে দিত। এমনি করে ফবুর্গ অঞ্চলের বিপ্লবী শ্রমিকদের ব্যাপকভাবে অস্ত্র সরবরাহ করা হতে থাকে। ন্যালে নামে একটি লোক বলে, তার কাছে ৭০০ কার্তুজ আছে।
একজন আসবাপত্র বিক্রেতা অন্য একজন দোকানদারকে বলে, আমরা এবার কাৰ্থ আক্রমণ করব।’ তখন অন্য দোকানদার বলে, তোমরা শীঘ্রই আক্রমণ শুরু করবে। গত মাসে তোমরা সংখ্যায় ছিলে পনেরো হাজার। এখন হয়েছ সংখ্যায় পঁচিশ হাজার।
বিপ্লবের এই উত্তাপ-উত্তেজনা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। শুধু প্যারিস নয়, ফ্রান্সের কোনও অঞ্চল বাদ পড়েনি। বিপ্লবের এই প্রস্তুতির জন্য কতকগুলি সংস্থা গড়ে উঠেছিল যেমন সোসাইটি অফ ফ্রেন্ডস অফ দি পিপল আর দি রাইট অফ ম্যান। লিগ অফ দি রাইট অফ ম্যান আবার লিগ অফ অ্যাকশন নামে আর একটি দল গড়ে তোলে।
প্যারিসের পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবের এই উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। লেয়নস, নান্তে, লিলে, আর মার্শাই অঞ্চলে দি লিগ অফ দি রাইট অফ দি ম্যান-এর কাজকর্ম বেড়ে যায়। তবে প্যারিসের ফবুর্গ সেন্ট আলতানের থেকে ফবুর্গ সেন্ট মার্সোতে বিক্ষোভ বেড়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ স্কুল-কলেজের ছাত্রাবাসগুলোতেও শ্রমিকদের অঞ্চলের মতোই বিপ্লবের উত্তপ্ত প্রস্তুতি চলতে থাকে।
সেনাবাহিনীর লোকেরাও এই গণবিপ্লবে যোগদান করতে থাকে। বেনকেতি, লুনেভিল ও এপিনালে যে বিদ্রোহ দেখা দেয় তাতে সেনাবাহিনীর অনেক লোকও ছিল। বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর সমর্থনের ওপর অনেকখানি নির্ভর করত।
এই ছিল তখনকার বিপ্লবের অবস্থা। তবে এ বিপ্লবের প্রস্তুতিপর্বের কেন্দ্রস্থল ছিল ফবুর্গ সেন্ট আঁতোনে। এই অঞ্চলের পরিশ্রমী, সাহসী ও মৌমাছির মতো স্পর্শকাতর শ্রমিকরা দলে দলে প্রস্তুত হয়ে উঠছিল বিপ্লবের জন্য। কিন্তু তারা তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম বন্ধ করেনি। বিপদের সময়ে তাদের দারিদ্র আর বুদ্ধি দুটোই বেড়ে যায়।
ফবুর্গ সেন্ট আঁতোনেতে বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতার যে আতিশয্য আর উত্তাপের আধিক্য দেখা যায় তার কারণও ছিল যথেষ্ট। অর্থনৈতিক সংকট এই অঞ্চলেই চরমে ওঠে। অভাব, ধর্মঘট আর বেকারত্ব অশান্ত আর বিক্ষুব্ধ করে তোলে এ অঞ্চলের লোকদের। আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন, আত্মাভিমানী, পরিশ্রমী শ্রমিকরা দীর্ঘদিনের অবজ্ঞা ও অবহেলায় প্রচণ্ডভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাদের অন্তর্নিহিত সমস্ত শক্তি সংহত ও সুসংবদ্ধ হয়ে ফেটে পড়তে থাকে। শুধু স্ফুলিঙ্গের প্রতীক্ষায় স্তব্ধ হয়ে থাকে তারা।
আমরা আগেই যে সব মদের দোকানগুলোর কথা উল্লেখ করেছি সেগুলো বৈপ্লবিক কাজকর্মের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। এই সব দোকানগুলোতে যারা আসত তারা মদের থেকে উত্তেজনাময় কথায় মত্ত হয়ে উঠত বেশি।
বিভিন্ন জায়গায় বিপ্লবের যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে ওঠে তার মাঝে জনগণের সার্বভৌমত্ব উঁকি দিতে পারে। এই বিপ্লবী জনগণের আচরণ সব সময় ভালো না হতে পারে, তাদের কিছু ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। সেই সব ভুলভ্রান্তি সত্ত্বেও তাদের মহত্ত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে। তারা কী চেয়েছিল?
তারা চেয়েছিল সমস্ত অত্যাচার আর অবিচারের অবসান ঘটাতে। সব বেকার লোকের জন্য কাজ আর ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা চেয়েছিল। তাদের স্ত্রীদের জন্য চেয়েছিল নিরাপত্তা চেয়েছিল সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা এবং যথেষ্ট খাদ্য। তারা চেয়েছিল পৃথিবীকে স্বর্গ করে তুলঁতে। তারা চেয়েছিল প্রগতি, জাতীয় অগ্রগতি। তবে তাদের চাওয়ার ধরনটা ছিল ভয়ঙ্কর। তাদের মুখে ছিল উত্তপ্ত শপথ এবং হাতে ছিল অস্ত্র। তারা সভ্যতার জন্যই বর্বর হয়ে পড়েছিল।
.
৬.
এঁজোলরাস এই সময় তার শিষ্যদের সংখ্যা আর মনের অবস্থাটা একবার যাচাই করে দেখতে চাইল। সেদিন কাফে মুসেঁতে আলোচনা চলছিল ওদের নিজেদের মধ্যে। সে উপমা-অলঙ্কার সহযোগে তাদের বোঝাতে লাগল। সে বলল, এখন দেখ তো আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের প্রকৃত অবস্থা কী। এমন সব সক্রিয় লোকদের আমাদের খুঁজে নিতে হবে যারা লড়াই করতে পারবে। এখন দেখতে হবে আমাদের দলে কত লোক আছে। এখন নষ্ট করার মতো সময় নেই। তাড়াতাড়ি সব কাজ সারতে হবে। আমরা কতখানি এগিয়েছি তা পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। এক অপ্রতাশিত ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কুরফেরাক, তুমি পলিটেকনিক ছাত্রদের কাছে গিয়ে দেখ, আজ তাদের ছুটির দিন। আজ বুধবার। ফুলি, তুমি গ্রেসিয়ারের শ্রমিকদের কাছে যাও। কমবেফারে বলেছে সে পিকপাসে যাবে, সেখানে অনেক ভালো লোক আছে। প্রভেয়ার, তুমি র্যু দ্য গ্রেনেলে রাজমিস্ত্রিদের কাছে যাবে, তারা হতোদ্যম হয়ে পড়েছে। জলি দুপুত্রেন হাসপাতালে গিয়ে মেডিকেল ছাত্রদের অবস্থাটা যাচাই করে দেখবে। বোসেত প্যানে দ্য জাস্টিনে গিয়ে আইনের ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করবে। আমি কুরবোর্গের ব্যাপারটা দেখব।