সাম্যবাদীরা ও কৃষিব্যবস্থার সংস্কারকরা বণ্টন সমস্যার সমাধান করে বলে প্রচার করে। বেড়ায়। কিন্তু এটা তাদের ভুল ধারণা। তাদের উৎপাদন পদ্ধতির ত্রুটিই উৎপাদনকে ব্যাহত করে। সমবণ্টনের ব্যবস্থা কায়েম হলে উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে যায় এবং তার ফলে শ্রমও উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হলে জাতীয় সম্পদ নষ্ট হয় আর জাতীয় সম্পদের উৎপাদন কমে গেলে তার সমবণ্টনের কোনও অর্থ হয় না। সাম্যবাদীরা যেন একধরনের কসাই যারা কোনও জিনিস সকলের মধ্যে বণ্টন করে দিতে গিয়ে নিজেরাই গ্রাস করে ফেলে।
আসলে এ দুটি সমস্যাকে পৃথক করে দেখলে চলবে না। একই সমস্যার এ হল দুটি দিক মাত্র। এ দুটি সমস্যার সমাধান একই সঙ্গে করতে হবে। সমাজতন্ত্রের কথা হল ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপসাধন এবং সমস্ত রকম শোষণের বিলোপসাধন। সমাজবাদীদের মতে রাষ্ট্রের মানুষ শ্রেণি নির্বিশেষে দেশের সব সম্পত্তির মালিক। তারা সম্পদ উৎপাদন করবে এবং সে সম্পদ সমানভাবে ভাগ করে নেবে। এইভাবে পার্থিব উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক উন্নতি সাধন করবে।
সমাজতন্ত্রবাদীরা এটাই চেয়েছিল এবং এই সমস্যাটাই সবচেয়ে বিব্রত করে তোলে লুই ফিলিপকে। দার্শনিকরা তখন এক আদর্শ গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন যে আদর্শ একই সঙ্গে প্রাচীন ভাবধারা এবং বৈপ্লবিক আদর্শের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে, যা সংসদ ব্যবস্থা এবং রাস্তার জনগণকে মিলিয়ে দেবে, সমস্ত দলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবসান ঘটাবে।
লুই ফিলিপ দেখলেন তাঁর পায়ের তলায় মাটি কাঁপছে। দিগন্তে মেঘ ঘনিয়ে উঠছে। জুলাই বিপ্লবের কুড়ি মাস যেতে না যেতেই চারদিক থেকে বিপদ ঘনীভূত হয়ে উঠল। ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ফ্রান্সের দিকে। ফ্রান্স তখন অস্ট্রিয়া ও আনকোনার সঙ্গে পেরে উঠছিল না। মেটারনিক তখন ইতালিতে বলগোনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। জার নিকোলাসের ওপর রুশ জনগণের ঘৃণা বেড়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। স্পেন আর পর্তুগাল শত্রু হয়ে উঠেছিল ফ্রান্সের। তার ওপর গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল প্যারিসে।
.
৫.
এপ্রিলের শেষের দিকে অবস্থা আরও খারাপের দিকে গেল। ১৯৩০ সাল থেকে ছোটখাটো অনেক আন্দোলন এবং গোলমাল চলছিল এবং সে গোলমাল এবং আন্দোলন দমনও করা হচ্ছিল। তখন সমগ্র ফ্রান্স প্যারিসের দিকে তাকিয়ে ছিল এবং প্যারিস তাকিয়ে ছিল ফবুর্গ সেন্ট আঁতোনের দিকে।
ফবুর্গ সেন্ট আঁতানে তখন গরম আগুনের মতো হয়ে উঠেছে। র্যু দ্য শারানের অবস্থা তখন ছিল একই সঙ্গে শান্ত এবং বিক্ষুব্ধ। বিভিন্ন হোটেলে তখন শ্রমিকরা শুধু বিপ্লবের কথা আলোচনা করত। প্রায় সব কলকারখানার শ্রমিকরা তখন আন্দোলনে নেমে পড়েছিল। একদিন একটা হোটেলে একজন শ্রমিক বলল, আমরা তিনশোজন শ্রমিক আছি। রোজ যদি দশ স্যু করে দিই তা হলে মোট দেড়শো ফ্রাঁ হবে এবং তাই নিয়ে গুলি আর বারুদ কেনা হবে। আর একজন শ্রমিক বলে, আমাদের আর এখন ছ’মাস সময় চাই না! এমনি আমরা সংখ্যায় পঁচিশ হাজার হয়ে উঠেছি এবং আমরা সরকারের শক্তির সমান হয়েছি। আর একজন শ্রমিক বলে, আমাদের অস্ত্র নেই। তখন আর একজন উত্তর করে, “কেন, সেনাবাহিনীর হাতে অস্ত্র আছে।’
এইভাবে তখন দারুণ উত্তেজনা চলছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। যেখানে-সেখানে শ্রমিকদের গোপন ও প্রকাশ্য সভা বসত। সেই সব সভায় তারা বিপ্লবের জন্য শপথ করত। আবার এই উত্তপ্ত উত্তেজনায় আবহাওয়ার সুযোগ নিয়ে অনেকে অন্যায় ও অনৈতিক কাজ করে বসত। এক একদিন একটি লোক একটি কাফেতে ঢুকে মদ খেয়ে তার দাম না দিয়েই বেরিয়ে যাবার সময় বলত, বিপ্লব এই মদের দাম দেবে। বিভিন্ন কাফেতে সাধারণ জনগণের ভোটের মাধ্যমে বিপ্লবের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হত।
এই সময় মেয়েরাও বসে ছিল না চুপ করে। একদিন একট মেয়ে বলে, আমরা বেশ কিছুদিন ধরে দারুণ পরিশ্রম করে কার্তুজ বানাচ্ছি। একদিন মার্শে লেনয়ের অঞ্চলের এক মদের দোকানের বাইরে সীমানা নির্ধারণসূচক একটা পাথরের স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে কালো দাড়িওয়ালা একটা লোক গোপন জায়গা থেকে আসা একটা কাগজ পড়ে শোনাচ্ছিল একদল লোককে। একদল লোক তার সামনে জড়ো হয়ে ভিড় করে সেই পড়া শুনছিল। লোকটা কাগজের কথাগুলো পড়ে যাচ্ছিল, আমাদের নীতি চেপে দেওয়া হয় জোর করে, আমাদের প্রচারপত্র ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। সম্প্রতি তুলাশিল্প বন্ধ হয়ে পড়লে অনেক নরমপন্থী চরমপন্থী হয়ে ওঠে। আমাদের গোপন আস্তানাগুলোতে জনগণের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠছে। আজ আমাদের দুটো পথের একটাকে বেছে নিতে হবে–হয় ক্রিয়া না হয় প্রতিক্রিয়া, বিপ্লব না হয় প্রতিবিপ্লব। এখন নিরপেক্ষতা বা নিষ্ক্রিয়তার কোনও স্থান নেই। এখন হয় জনগণের জন্য লড়াই করতে হবে অথবা জনগণের বিরুদ্ধে যেতে হবে। যদি আমরা তোমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে না পারি তা হলে আমাদের ধ্বংস করে ফেল, কিন্তু আজ আমাদের সাহায্য কর সর্বপ্রকারে।
এই ধরনের অনেক ঘটনা ঘটত। আর একদিন একটি লোক এসে পথের ধারে একটি স্তম্ভের উপর উঠে দাঁড়িয়ে বলতে থাকে, বামপন্থী বিরোধীপক্ষের লোকরা বিশ্বাসঘাতক। তারা একধারে গণতন্ত্রবাদী ও রাজতন্ত্রবাদী সেজে আমাদের বোকা বানাতে চায়। তারা মার খাবার ভয়ে গণতন্ত্রবাদী সাজে। আবার লড়াই করতে হবে না বলে রাজতন্ত্রবাদী বলে নিজেদের প্রচার করে বেড়ায়। প্রজাতন্ত্রীরা হল ভেড়ার চামড়া ঢাকা নেকড়ে। হে শ্রমিকবৃন্দ, তোমরা তাদের সম্বন্ধে সতর্ক হয়ে ওঠ।’ আর একজন তখন তার পেছন থেকে বলে ওঠে, থাম শ্রমিকদের চর কোথাকার।’ সে কথায় চুপ করে যায় লোকটা। একদিন সন্ধেবেলায় একজন শ্রমিক মাঠের মাঝে একটা ক্যানেলের ধারে একজন ভালো পোশাকপরা লোককে দেখতে পায়। লোকটি তখন তাকে প্রশ্ন করে, কোথায় যাচ্ছ নাগরিক?’ শ্রমিকটি তখন উত্তর করে, আমি আপনাকে চিনি না।’ লোকটি তখন বলল, ‘কিন্তু আমি তোমাকে চিনি।’ শ্রমিকটি বলে, আমি হচ্ছি কমিটি এজেন্ট। তোমাকে বিশ্বাস করি না আমরা। আমাদের কোনও কথা যদি ফাঁস করে দাও, আমরা বাকি রেখে দেব না তোমায়। আমরা নজর রাখব তোমার ওপর।’