.
৪.
রাজসিংহাসনে বসার জন্য বলপ্রয়োগ করতে হয়নি লুই ফিলিপকে। রাজবংশের সন্তান হিসেবে সিংহাসনে অধিকার ছিল তার। তার ওপর তিনি জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা রাজা নির্বাচিত হন। তাঁর বিশ্বাস ছিল এই নির্বাচন আইনসংগত এবং এই রাজপদ গ্রহণ করা তাঁর কর্তব্য। লুই ফিলিপ সরল বিশ্বাসে সিংহাসনে বসেন আর গণতন্ত্রও সরল বিশ্বাসে তাঁকে আক্রমণ করে। রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব যেন প্রকৃতির দুটি প্রধান বস্তুর মধ্যে দ্বন্দ্ব। তাদের দ্বন্দ্ব দেখে মনে হয় জলের প্রতিনিধিরূপ সমুদ্র বাতাসের প্রতিনিধিরূপ ঝড়ের সঙ্গে এক দ্বন্দে মেতে উঠেছে।
১৮৩০ সালে রাজার শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গে গোলযোগ শুরু হয়, নানারকমের আন্দোলন আর বাদ-প্রতিবাদ শুরু হয়।
ইউরোপের অন্য সব দেশ জুলাই বিপ্লবকে ভালো চোখে দেখেনি এবং ফ্রান্সের মধ্যেও এই বিপ্লব সম্বন্ধে নানারকম ব্যাখ্যা করা হয়। অনেক রাজনৈতিক মত এবং দল গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের যে বিধান মূর্ত হয়ে ওঠে সে বিধানের কথা কেউ বুঝতে পারে না। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শান্ত বিত্তের যে সব মানুষ শান্ত ও নিষ্ক্রিয়ভাবে সব কিছু প্রত্যক্ষ ও পর্যালোচনা করার পর কাজ শুরু করে তখন ঘটনার স্রোত অনেক দূর এগিয়ে যায়। অনেক কিছু ঘটে যায়। দেশের পুরনো রাজনৈতিক দলগুলো সব সময় বিপ্লবকে বাধা দেবার চেষ্টা করে। তারা যেন স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটার চেষ্টা করে। তাদের মতে রাজ্যশাসনে রাজার বংশগত অধিকার আছে, সুতরাং যে রাজদ্রোহিতা থেকে বিপ্লবের জন্ম সে বিদ্রোহ দমনের অধিকার রাজার আছে। সব বিদ্রোহের পেছনে থাকে এক অন্ধ ক্রোধ। কিন্তু সব বিপ্লবের মূলে থাকে এক আদর্শ, এক প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেকে সে বিপ্লবকে বাধা দেয়। বাধাদানকারীরা বলতে লাগল, এ বিপ্লব রাজাকে সিংহাসনে বসাবার বিপ্লব। এ বিপ্লবের অর্থ হয় না। ১৮৩০ সালের বিপ্লব দেউলে হয়ে পড়ে সবদিক দিয়ে। প্রজাতন্ত্রীরা ও গণতন্ত্রবাদীরা একযোগে আক্রমণ করে তাকে। একদিকে ছিল যুগ-যুগান্তকারী রাজতন্ত্র আর অন্যদিকে ছিল গণতান্ত্রিক অধিকার। একদিকে অতীত, অন্যদিকে ভবিষ্যৎ। দু দিকে চাপ পাচ্ছিল এই বিপ্লব। বৈদেশিক ব্যাপারে এ বিপ্লবের এক তাৎপর্য ছিল। কারণ এ বিপ্লবের ফলে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ইউরোপের অন্য রাষ্ট্রগুলো খুশি হয়। তারা সমর্থন করে এ বিপ্লব। অভ্যন্তরীণ দিক থেকেও এর একটি তাৎপর্য ছিল। এ বিপ্লব রাজতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলেও সে রাজতন্ত্রকে প্রতিক্রিয়াশীল বলা যায় না কোনওক্রমে। তাছাড়া ইউরোপীয় কায়দায় অন্যান্য দেশের মতো এখানেই রাজ্যশাসনে রাজাকে পরামর্শ দেবার জন্য মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।
ইতোমধ্যে অসংখ্য সমস্যা এসে দেখা দেয় রাজসরকারের সামনে। দারিদ্র্য, সর্বহারা, বেতনহার, শিক্ষা, শান্তি, বেশ্যাবৃত্তি, নারীসমাজের অবস্থা, উৎপাদন, বণ্টন, ভোগ, বিনিময়, মুদ্রাব্যবস্থা, মূলধন ও শ্রমের অধিকার–এই সব সমস্যা একসঙ্গে এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে।
জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরেও একটি আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছিল। সে আন্দোলন হল চিন্তাশীল ব্যক্তিদের আন্দোলন। জনগণ যখন বিপ্লবের তরঙ্গের ঘাত-প্রতিঘাতে দুলছিল, চিন্তাশীল ব্যক্তিরা তখন তাদের অনেক উর্ধ্বে তত্ত্বকথা চিন্তা করছিলেন। এঁরা রাজনৈতিক অধিকারের ব্যাপারটা পুরোপুরি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়ে শুধু দেশের জনসাধারণের অর্থনৈতিক অধিকার এবং সুখশান্তির কথা চিন্তা করতে থাকেন। এঁরা ব্যক্তিগতভাবে বা সমষ্টিগতভাবে চিন্তা করলেও এঁরা সবাই নিজেদের সমাজতন্ত্রবাদী বলে অভিহিত করতেন এবং এই নামেই তারা পরিচিহ্নিত ছিলেন।
এই সব সমাজতন্ত্রবাদীরা যে দুটি সমস্যাকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতেন সেগুলো হল সংখ্যায় দুটি। প্রথম সমস্যা হল উৎপাদন এবং দ্বিতীয় সমস্যা হল বন্টন। উৎপাদন সমস্যার মধ্যেই আছে শ্রম অর্থাৎ সম্পদ সৃষ্টিতে মানবিক শক্তি প্রয়োগের প্রশ্ন। বণ্টন সমস্যার মধ্যে আছে বেতনের প্রশ্ন এবং কিভাবে দেশের শ্রমজাত সম্পদ দেশের লোকের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া যায় তার কথা।
দেশের মানবিক শক্তি ও শ্রমের যথাযথ প্রয়োগে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তোলে। আর সুষম বণ্টন দেশের মানুষের সুখশান্তি বৃদ্ধি করে। সুষম বণ্টন মানে অবশ্য সমবণ্টন নয়, সুষম বণ্টন মানে ন্যায়সংগত বন্টন অর্থাৎ দেশের জাতীয় সম্পদ বন্টনের ব্যাপারে যেন অন্যায় অসাম্য না থাকে। দেশের সব মানুষ যেন খেতে পায়, ভালোভাবে সুখে-শান্তিতে জীবন ধারণ করতে পারে। বণ্টনের এই সমতার নীতিই হল সাম্যের মূল ভিত্তি।
এই দুটি সমস্যার সমাধান মানেই দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়া এবং দেশের প্রতিটি মানুষের সুখসম্পদ বৃদ্ধি পাওয়া। তার মানেই সামাজিক সম্পদ বৃদ্ধি, তার মানেই এক স্বাধীন সুখী জাতির উদ্ভব।
ইংল্যান্ড উৎপাদন সমস্যার সমাধান করেছে। জাতীয় সম্পদের বৃদ্ধিতে দারুণ সফল হয়েছে। কিন্তু তার বণ্টন ব্যবস্থা খুবই খারাপ। তার ফলে একদিকে বিরাট সম্পদ, আর একদিকে বিরাট দারিদ্র। দেশের যত সব সম্পদ মুষ্টিমেয় সামান্য কিছুসংখ্যক লোক ভোগ করে আর বিরাট সংখ্যক জনসাধারণ ভোগ করে শুধু দুঃখ আর দারিদ্র্য। যে রাষ্ট্রের মধ্যে জাতীয় সম্পদ ব্যক্তিগত অভাব এবং দারিদ্র্যের ওপর নির্ভরশীল সে রাষ্ট্র সত্যিই বিপজ্জনক। এ নীতি যারা সমর্থন করে তারা নীতিহীন যুক্তিহীন এক জড়বাদেরই সমর্থক।