তিনি কখনও গির্জায় যেতেন না, শিকার করতে যেতেন না অথবা কোনও অপেরা বা নাচগানের আসরেও যেতেন না। বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য অন্য রাজারা তখন সাধারণত এই সব করত। কিন্তু লুই ফিলিপ ছিলেন স্বতন্ত্র। তিনি ছাতা হাতে অনেক সময় রাস্তায় বেড়াতেন।
ইতিহাসে রাজা লুই ফিলিপের বিরুদ্ধে তিন রকমের অভিযোগ পাওয়া যায়। এ অভিযোগ হল তার ব্যক্তিত্ব এবং রাজ্যশাসনের বিরুদ্ধে। বাড়ি নির্মাণ, বাগানের কাজ আর ঔষধিবিদ্যায় বিশেষ আগ্রহ ছিল তাঁর। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো হল গণতান্ত্রিক অধিকারের কণ্ঠরোধ, দেশের জাতীয় অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি, গণবিক্ষোভ দমন এবং বিদ্রোহ দমনে সেনাবাহিনী নিয়োগ এবং দেশে পুরোপুরিভাবে আইনের অনুশাসন প্রবর্তন না করা। তাছাড়া বেলজিয়ামকে প্রত্যাখ্যান এবং ইংরেজদের ভারত জয়ের মতো বর্বরোচিত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে আলজিরিয়া জয় তাঁর রাজত্বকালের ত্রুটি। আসলে ফ্রান্সের জাতীয় গৌরব বৃদ্ধির ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যুৎসাহী। এটাই তাঁর বড় দোষ। তার সঙ্গে তাঁর রাজবংশের ভাবমূর্তিটাকেও অতিমাত্রায় উজ্জ্বল করে তুলঁতে চেয়েছিলেন তিনি।
একদিকে রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা আর অন্যদিকে বিপ্লব এই দুই-এর মধ্যে যে বৈপরীত্য ছিল সে বৈপরীত্য যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিল তার মধ্যে। ১৮৩০ সালে এই বৈপরীত্য থেকে লাভবান হয়েছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন সে যুগের উপযুক্ত এক রাজা। গাঁয়ে রাজরক্ত থাকা সত্ত্বেও নির্বাসনে থাকাকালে বিদেশে দারুণ দুরবস্থার মধ্য দিয়ে চলতে হয় তাঁকে। এক বিরাট ধনী ও সমৃদ্ধিশালী দেশের রাজবংশের সন্তান হয়েও সুইজারল্যান্ডে নির্বাসনে থাকাকালে একদিন খাবারের টাকা জোগাড়ের জন্য একটি ঘোড়া বিক্রি করতে হয় তাকে। বিশেনতে যাবার সময় তিনি এক জায়গায় অঙ্ক শিখিয়ে কিছু রোজগার করেন এবং তাঁর বোন অ্যাদেলেজ সূচিশিল্পের কাজ করতেন। এই সব কারণে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন দেশে ফিরে আসার পর।
রাজা হবার পর তিনি সেন্ট মাইকেলে রক্ষিত বন্দিদের রাখার জন্য লোহার খাঁচাটি নিজের হাতে ধ্বংস করেন। এই খাঁচাটি রাজা একাদশ লুই-এর আদেশে নির্মিত হয় এবং পঞ্চদশ লুই-এর আদেশে ব্যবহৃত হয়। লুই ফিলিপের ব্যক্তি হিসেবে দোষের থেকে রাজা হিসেবে কর্তব্যচ্যুতির দোষই বেশি। তার রাজকীয় কর্তব্যের থেকে তাঁর পরিবারের কর্তব্যকেই বড় বলে মনে করতেন তিনি। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর মধ্যে এই অভিযোগটাই সবচেয়ে বড়।
তার পুত্রকন্যাদের মনের মতো করে মানুষ করে তোলেন তিনি। তাঁর এক কন্যা মেরি দ্য অর্পিয়ান্স শিল্পী হিসেবে নাম করেন এবং চার্লস দ্য অর্পিয়ান্স নামে এক পুত্র কবি হিসেবে নাম করেন। মেরি জোয়ান অব আর্কের যে একটি প্রতিমূর্তি নির্মাণ করেন, তা তাঁর উন্নত মানের শিল্পীমানসের এক গৌরবময় কৃতিত্বের পরিচয় বহন করে। তার আরও দুটি পুত্র গুণবান হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। পরবর্তীকালে মেটারনিক তাঁদের সম্বন্ধে মন্তব্য করেন, যুবক হিসেবে তারা বিরল।
যৌবনে লুই ফিলিপ ছিলেন দুমোরিজের সহকর্মী এবং লাফায়েত্তের বন্ধু। তিনি ছিলেন জ্যাকোবিন ক্লাবের সদস্য। মিরাববা তাঁর কাঁধের উপর একটা চাপড় দেয় এবং দাঁতন তাঁকে ‘যুবক’ বলে সম্বোধন করে। ১৭৯৩ সালে কনভেনশনের পেছনের বেঞ্চে বসে ষোড়শ লুই-এর বিচার স্বচক্ষে দেখেন। এক অন্ধ অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন যে বিপ্লব রাজা এবং রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ সাধন করে, সে বিপ্লবের উগ্র ভাবধারার চাপে কিভাবে একটি মানুষ নিষ্পেষিত হয় তা লুই ফিলিপ দেখেন। কিন্তু লুই বুঝতে পারেন জনগণের আসল ক্ষোভ হল রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং সে ক্ষোভ ন্যায়সঙ্গত, ঈশ্বরের বিধানের মতোই সে ক্ষোভের প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব না করে পারেননি লুই ফিলিপ।
তাঁর মনের ওপর বিপ্লবের প্রভাব ছিল অপরিসীম। সেই বিপ্লবের কয়েক বছরের সব ঘটনা এক জীবন্ত ছবির মতো তাঁর মনে জাগ্রত থাকে সব সময়।
রাজা হওয়ার পর জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন তিনি। তাঁর রাজত্বকালে মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রকাশ এবং প্রচারের ব্যাপারে সংবাদপত্রগুলোর স্বাধীনতা ছিল। আইন-আদালতের কাজে কোনওরূপ হস্তক্ষেপ করতেন না রাজা। নাগরিকরা স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারত। জনগণ রাজার যেকোনও কাজের সমালোচনা করতে পারত স্বাধীনভাবে।
যে ইতিহাস সব রাজা ও রাজশক্তির বিচার করে, লুই ফিলিপ সম্বন্ধে সেই ইতিহাসের বিচারে কিছু ভুলভ্রান্তি আছে। তবে প্রখ্যাত কঠোরমনা ঐতিহাসিক লুই ব্লা পরে লুই ফিলিপ সম্বন্ধে তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন করেন।
সিংহাসন ও রাজ্যশাসনের কথা ছেড়ে দিয়ে লুই ফিলিপকে যদি আমরা মানুষ হিসেবে দেখি তা হলে কী দেখব? মানুষের প্রতি তাঁর দয়া এবং করুণা তার অন্য সব মহত্ত্বকে আচ্ছন্ন করে দিয়েছে। তাঁর শত কাজ এবং চিন্তা-ভাবনার মাঝে এবং সারাদিন যুদ্ধক্ষেত্রে কাটিয়ে ও সারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে বাড়ি ফিরে তিনি সারারাত ধরে ফৌজদারি বিচারের সব কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখতেন। বিশেষ করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামিদের প্রতি তাঁর দয়া ছিল অপরিসীম। কিভাবে তাদের বাঁচানো যায় তার জন্য বিশেষ নিষ্ঠা ও আগ্রহের সঙ্গে চেষ্টা করতেন। সরকারপক্ষের উকিল ও রাজকর্মচারীদের কাজে আস্থা রাখতে পারতেন না তিনি। গিলোটিনে ফাঁসি দেওয়া পছন্দ করতেন না তিনি। গিলোটিনের পরিবর্তে তিনি সাধারণ ফাঁসিমঞ্চের ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করেন। একবার তিনি সাতজন আসামির মৃত্যুদণ্ড মওকুব করেন।