কিন্তু কেন? কারণ ক্ষুধা থেকে অভাব থেকে সহসা প্রাচুর্যের মধ্যে পড়ে যায় তারা। গতকাল যেখানে ছিল কুণ্ঠার তাড়না, আজ সেখানে দেখা দেয় প্রাচুর্য, কাল আবার সেখানে দেখা দেবে উদ্বৃত্ত। নেপোলিয়ন ক্ষমতার আসীন হবার পর ১৮১৪ সালে যা হয়েছিল দশম চার্লস-এর পর ফ্রান্সে আবার তারই পুনরাবৃত্তি ঘটে।
ভুল করে বুর্জোয়াদের তখন একট পৃথক শ্রেণি হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু আসলে তারা ছিল জনগণেরই একটি পরিতৃপ্ত অংশ। তারা তখন আরাম কেদারায় বসে বিশ্রামে ব্যস্ত ছিল। তাদের দোষ এই যে তারা দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির দিকে না তাকিয়ে নিজেদের আরাম উপভোগে মত্ত হয়ে থাকত। তারা বুঝতে পারেনি দেশের কিছু লোক যদি ব্যস্ত ও অশান্ত হয়ে ওঠে তা হলে দেশের অগ্রগতি ব্যাহত হয়। এটাই হল বুর্জোয়াদের ব্যর্থতা। দেশের সবাই এগিয়ে যাবে আর কিছু লোক আত্মস্বার্থে মগ্ন হয়ে থাকবে, এটা কখনও চলতে পারে না।
১৮৩০ সালের মত্ততার পর ফরাসি জাতির বুর্জোয়া নামে একটি অংশ বিশ্রামের জন্য থামতে চেয়েছিল। তারা ঘুমোয়নি, বা স্বপ্ন দেখেনি অথবা আত্মবিস্মৃত হয়ে থাকেনি। তারা শুধু থামতে চেয়েছিল। কিন্তু কোনও সামরিক অভিযানের সময় সৈনিকদেরও মাঝে মাঝে বিশ্রাম করার জন্য হুকুম দেওয়া হয় যাতে তারা বিশ্রামের পর দেহে নতুন শক্তি আর মনে উদ্যম পায়। কিন্তু থামা হল গতকালকার যুদ্ধ আর আগমী কালের যুদ্ধের মাঝখানে এক সজাগ সতর্ক বিরতি এবং সে থামার হুকুম দেওয়ার জন্য থাকে এক সেনাপতি বা সেনানায়ক।
বুর্জোয়াদেরও থামার হুকুম দেওয়ার জন্য একজন নেতা বা নায়কের প্রয়োজন ছিল। অর্ডিয়ান্সের লুই ফিলিপই হল সেই লোক।
জাতীয় আইনসভার ২২১ জন ডেপুটির ভোটে লুই ফিলিপ রাজা নির্বাচিত হন। লাফায়েত্তে সে সভায় সভাপতিত্ব করার সময় প্রজাতন্ত্রের গুণগান করে। ১৮৩০-এর বিপ্লবের এটাই হল কৃতিত্ব।
কিন্তু পরে এই জোড়াতালি দেওয়া সমাধানের মধ্যে একটি বিরাট দুর্বলতা ধরা পড়ে। এত করা সত্ত্বেও জনগণের মৌল অধিকারের প্রতি কোনও সম্মান দেখানো হয়নি।
.
২.
বিপ্লবের হাত যত শক্তিশালীই হোক, তার অস্ত্র যত জোরালোই হোক, তার মধ্যে কতকগুলি ভুল-ত্রুটি থাকে। বিপ্লবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে আমাদের বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। বিপ্লবেরও দোষ থাকতে পারে এবং ১৮৩০ সালের বিপ্লবও সে দোষ থেকে মুক্ত নয়।
১৮৩০ সালের বিপ্লব প্রথমে ঠিক পথেই চলতে শুরু করেছিল। রাজতন্ত্রের মধ্যে দোষগুণ যা-ই থাক, রাজার একটা ব্যক্তিগত মূল্য আছে। লুই ফিলিপ সত্যিই একজন ভালো লোক ছিলেন। তাঁর পিতা যেমন নিন্দার পাত্র ছিলেন লুই ফিলিপ তেমনি ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র।
তাঁর অনেক ব্যক্তিগত গুণ ছিল। তিনি ছিলেন স্থিতধী, শান্তিপ্রিয়, ধৈর্যশীল, সকলের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন এবং স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত। অথচ তাঁর বংশের পূর্বপুরুষরা অবৈধ নারীসংসর্গে অভ্যস্ত। আসলে তিনি যেন গুণানুশীলনের দিক থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির একজন ছিলেন। আবার রাজকীয় আত্মমর্যাদার দিক থেকে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর বংশমর্যাদার প্রতি সচেতন থাকলেও তার সুমতি এবং যথেষ্ট বুদ্ধিবিবেচনা ছিল। তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ভাষার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষাও জানতেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে মিতবাক হয়েও প্রকাশ্য জনসভায় ভাল বক্তৃতা দিতে পারতেন। তিনি তার বংশের ও তার আমলের অন্য সব রাজাদের থেকে মানুষ হিসেবে খুব ভালো এবং বড় ছিলেন। তিনি নিজেকে বুর্বন না বলে অর্পিয়ান্স বলে অভিহিত করতেন। তিনি অনেক বই পড়তেন, কিন্তু সাহিত্যরস আস্বাদনে কোনও মতিগতি ছিল না। তিনি ছিলেন মোহমুক্ত এক রাজনীতিবিদ এবং কর্তব্যপরায়ণ। কোন কাজ আগে করতে হবে তা তিনি জানতেন। তিনি ছিলেন আত্মসম্প্রসারণশীল এবং প্রভুত্বপিয়াসী। তিনি সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে প্রতিকূল জনমতকে স্তব্ধ করতে পারতেন। তিনি দেশকে ভালোবাসতেন ঠিক, কিন্তু দেশের থেকে তাঁর বংশগৌরবকে বেশি ভালোবাসতেন। প্রভুত্বের থেকে আবার শাসনক্ষমতাকে বেশি ভালোবাসতেন। আবার আত্মমর্যাদার থেকে প্রভুত্বকে বেশি পছন্দ করতেন। তিনি আনকোনাতে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে এবং স্পেনে ইংল্যান্ডের সঙ্গে সাহসের সঙ্গে বোঝাপড়া করেন। তিনি বিশেষ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে ‘মার্সাই’ গান গাইতেন। কোনও কিছুতেই ভয় পেতেন না। সৌন্দর্য বা কোনও আদর্শবাদের প্রতি
তার কোনও অনুরাগ ছিল না। আবার যুক্তিহীন আবেগাত্মক উদারতা বা কোনওরূপ দিবাস্বপ্ন অথবা কোনও অলীক অবাস্তব ভাবধারার প্রতি তার কোনও প্রবৃত্তি ছিল না। তার পর্যবেক্ষণশক্তি ছিল তীক্ষ্ণ, কিন্তু কোনও অন্তর্দৃষ্টি ছিল না। বোধশক্তির তীক্ষ্ণতা, বাস্তব বুদ্ধি ও বাগ্মিতার দিক থেকে তিনি ছিলেন সিজার, আলেকজান্ডার আর নেপোলিয়নের সমতুল। তিনি ছিলেন এক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রবক্তা। সেই শতাব্দীর এক মহান লোক, এক ঐতিহাসিক শাসনকর্তা।
যৌবনে তিনি সুন্দর ছিলেন দেখতে। সমগ্র জাতি তাকে খুব একটা শ্রদ্ধা না করলেও সাধারণ মানুষ তাকে ভালোবাসত। তার মাথার চুল সব পেকে গেলেও তাকে বৃদ্ধ বলে মনে হত না। অভিজাত আর বুর্জোয়ার সংমিশ্রণ ছিল তাঁর চরিত্রে। নতুন এবং পুরনো চিন্তাধারা সমন্বিত এক যুগসন্ধিক্ষণের প্রতিমূর্তি ছিলেন লুই ফিলিপ। দশম চার্লস-এর মতো তিনি গ্রাদ ন্যাশনালের পোশাক পরতেন এবং নেপোলিয়নের মতো লিজিয়ন দ্য অনার-এর ব্যাজ ধারণ করতেন।