বুর্বন রাজবংশ হল ফ্রান্সের রক্তাক্ত ইতিহাসের মূল; কিন্তু ফ্রান্সের ভাগ্য বা রাজনীতির ভিত্তি হিসেবে তার কোনও ভূমিকা ছিল না। কুড়ি বছর ধরে শাসনক্ষমতা হারিয়ে দেশ ও জাতির ভাগ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তারা। তারা এ কথাটা বুঝতে পারেনি। তারা বুঝতে পারেনি রাজা সপ্তদশ লুই-এর রাজত্বকালেই থার্মিভরের ঘটনা ঘটে এবং অষ্টাদশ লুই-এর আমলে ম্যারঙ্গোর ঘটনা ঘটে। ইতিহাসের আদিকাল থেকে আর কোনও রাজা কখনও দেশের ঘটনা সম্পর্কে এমন ঔদাসীন্য দেখায়নি। এর আগে আর কখনও রাজার অধিকার জনগণের অধিকারকে অস্বীকার করেনি। ১৮১৪ সালের সনদে জনগণকে যে অধিকার দেওয়া হয়েছে তা অধিকার নয়, জনগণের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ, সে অধিকার গ্রাস।
রাজারা যখন দেখল রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার ফলে বোনাপার্টের ওপর রাজশক্তির জয় প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তাদের অধিকারের প্রতি সচেতন হয়ে উঠল জনগণ। জুলাই-এর কোনও এক সকালে জনগণ তাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত অধিকার সম্বন্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে অকস্মাৎ। তাদের ধারণা ছিল, রাজা জাতি ও নাগরিকদের ন্যায়সংগত অধিকার দান করতে চাইছেন না।
সুতরাং যে উদ্দেশ্যে রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা কার্যত ব্যর্থ হয়ে গেল। তা সত্ত্বেও একটা কথা স্বীকার করতে হবে যে এই রাজতন্ত্র অগ্রগতির পথে কোনও প্রতিকূলতা সৃষ্টি করেনি। এই রাজতন্ত্রের আমলে অনেক ভালো কাজও হয়েছিল।
পুনঃপ্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রের আমলে ফরাসি জাতি শান্তিপূর্ণ আলোচনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, যা প্রজাতন্ত্রের আমলে সম্ভব হয়নি। আবার সাম্রাজ্যবাদের যুগেও তা সম্ভব হয়নি। স্বাধীন ও শক্তিশালী ফ্রান্সের শান্তিপূর্ণ ভাবধারা ও জীবনভঙ্গিমা ইউরোপের অন্যান্য জাতিদের সামনে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। ফরাসি বিপ্লব রোবেসপিয়ারের মুখ দিয়ে অনেক বিক্ষুব্ধ কথা বলেছিল আর বোনাপার্টের অধীনে কামানগর্জনে ফ্রান্স অনেক কথা বলেছিল। কিন্তু অষ্টাদশ লুই আর দশম চার্লস-এর অধীনে দেশের বুদ্ধিজীবীরা কথা বলতে থাকে এবং সে কথা দেশের জনগণ শুনতে থাকে। ঝড় থেমে যাওয়ায় আবার সব আলো জ্বলে ওঠে। ঊর্ধ্বে আত্মার শান্ত আলোকে কাঁপতে দেখা যায়। তা দেখে আনন্দ পায় দেশের মানুষ। পনেরো বছর ধরে অনেক বড় বড় নীতি কাজ করতে থাকে, আগে রাজনীতিবিদরা যে নীতি কার্যকরী করতে পারেনি। আইনের আগে সাম্য, আত্মার স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, মত প্রচারের স্বাধীনতা, গুণী ব্যক্তিদের উপযুক্ত কাজ দান
এই সব কিছু ১৮১৫ থেকে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। ঈশ্বরের বিধানে বুর্বনরা সভ্যতার যন্ত্রস্বরূপ কাজ করতে থাকে।
জুলাই বিপ্লবের ফলে বুর্বন রাজবংশের পতনের মধ্যে যে একটি মহত্ত্ব ছিল সে মহত্ত্ব হল ফরাসি জাতির। বুর্বন রাজারা নীরবে সিংহাসন ত্যাগ করে চলে যায়। রাজসৈন্যের সম্মুখীন হয়ে এবং সামরিক শক্তির চাপ পেয়েও জনগণ খুব বেশি বিক্ষুব্ধ হয়নি। তারা রাজপরিবারে কোনও রক্তপাত ঘটায়নি, রাজারা সিংহাসন ছেড়ে পালিয়ে যান দেশ থেকে। এতে তারা শান্ত হয়ে ওঠে। জুলাই বিপ্লবের ফলে জনগণের যে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় সেই অধিকারই ছিল ন্যায় আর সত্য। সে অধিকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই বলপ্রয়োগের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।
.
২.
রাজনীতিবিদদের মতে কোনও দেশে বিপ্লবের পর তার পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে যদি রাজতন্ত্র কায়েম থাকে তা হলে সে দেশে এক রাজবংশের শাসন দরকার হয়। বিপ্লবের পর শান্তি প্রতিষ্ঠার দরকার। কিন্তু রাজা খুঁজে পাওয়া আর রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করা এক নয়। কাউকে রাজা করা যত সহজ কোনও রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করা তত সহজ নয়। নেপোলিয়নকে হঠাৎ রাজা করা হয়, ১৮২১ সালে মেক্সিকোর এক সেনাপতি ইতুর্বিদেকে সম্রাট করা হয়, পরে অবশ্য ১৮২৩ সালে তিনি আবার সিংহাসনচ্যুত হন। কিন্তু নেপোলিয়ন বা ইতুর্বিদে কেউ একটি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারেননি।
কিন্তু রাজবংশ প্রতিষ্ঠার জন্য কী কী দরকার? যে রাজা একই সঙ্গে বিপ্লবী, যিনি বিপ্লবে সক্রিয় অংশ গ্রহণ না করলেও বিপ্লবের ভাবাদর্শকে নীতিগতভাবে গ্রহণ করেন, আবার দেশের অতীত ইতিহাসের প্রতি সহানুভূতিশীল, যিনি দেশের ভবিষ্যতের কথাও ভাবেন সেই রাজাই এক রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারেন। বিপ্লবের পর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের জনগণ একজন ক্রমওয়েল ও নেপোলিয়নের মতো একজন শক্ত লোকের খোঁজ করেছিল। কিন্তু পরে তারা ব্যর্থ হয়ে আর এক বিপ্লবের পর একটি করে রাজবংশের খোঁজ করতে থাকে। ইংল্যান্ডের জনগণ ব্রানসউইক রাজবংশ এবং ফ্রান্সের জনগণ অর্ডিয়ান্স রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে। রাজবংশগুলো হচ্ছে ভারতীয় বটগাছের মতো যার ডালগুলো মাটিতে নুইয়ে পড়ে শিকড়ের মতো মাটিতে ঢুকে গিয়ে এক একটি গাছ হয়ে ওঠে। তেমনি এক একটি রাজা এক একটি রাজবংশ হয়ে উঠতে পারের যদি সে রাজা জনগণের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারেন।
কিন্তু রাজশক্তিকে অপসারিত করার জন্য ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লবও সফল হয়নি একেবারে। ১৮৩০ সালের সে বিপ্লবকে উপর থেকে সফল বলে মনে হলেও তা যেন মাঝপথে বাধা পেয়ে থেমে যায়। সে বাধা কে দিল? সে বাধা দান করে বুর্জোয়ারা।