জেভাৰ্ত কিন্তু নির্ভয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। থেনার্দিয়ের-পত্নী তখন তার দিকে তাকিয়ে বলল, এক পা-ও এগোবে না। তা হলে তোমার মাথাটা গুঁড়ো করে দেব।
জেভার্ত বলল, একজন যোদ্ধা যেন। তুমি পুরুষের মতো ব্যবহার করছ। কিন্তু আমার আছে নারীদের থাবা আর নখ।
এই বলে সে এগিয়ে যেতে লাগল। থেনার্দিয়ের-পত্নী পাথরটা ছুঁড়ে দিল। জেভাৰ্ত কায়দা করে পাশ কাটিয়ে গেল। পাথরটা তার মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। সেটা। সামনের দেয়ালে লাগায় কিছু চুন-বালি খসে গেল। তখন থেনার্দিয়ের-পত্নী কান্নায় ভেঙে পড়ল, আমার মেয়েরা।
জেভার্ত বলল, তাদের আগেই ধরেছি।
এই বলে সে একটা হাত থেনার্দিয়েরের মাথায় আর একটা হাত তার স্ত্রীর কাঁধের উপর দিয়ে তার লোকদের বলল, হাতকড়া লাগাও।
পুলিশরা সবার হাতে হাতকড়া লাগাবার পর ঘুমন্ত মাতাল লোকটাকে তুলঁল। সে বলল, কে জনদ্ৰেত্তে? সব ঠিক হয়ে গেছে।
জেভার্ত বলল, হ্যাঁ, সব কাজ হয়ে গেছে। হাতকড়া লাগানো লোকগুলোর মধ্যে তিনজনের মুখে মুখোশ ছিল আর তিনজনের মুখে চুনকালি মাখা ছিল। তাদের ভূতের মতো দেখাচ্ছিল।
জেভার্ত বলল, সবাই মুখোশ খুলে ফেল।
তারা সবাই মুখোশ খুলে ফেললে জেভার্ত তাদের অভ্যর্থনা জানাল। বলল, সান্ধ্য নমস্কার বিগ্রেনেল, ব্রুজোঁ, দিউ মিলিয়ার্দ। গুয়েলমার, বাবেত, আর ক্লাসেকাস, তোমাদেরও নমস্কার জানাই। মুখোশ পরায় তোমাদের চমৎকার দেখাচ্ছিল।
এবার বন্দির দিকে তাকিয়ে জেভার্ত বলল, ভদ্রলোকের বাঁধন খুলে দাও। কিন্তু আমার অনুমতি ছাড়া কেউ যেন বাইরে না যায়।
বন্দি এতক্ষণ সব কিছু দেখে যাচ্ছিল নীরবে। একটা কথাও বলেনি।
এবার জেভার্ট টেবিলের ধারে একটা চেয়ারে বসে তার রিপোর্ট লিখতে লাগল। লেখার পর সে বলল, এবার ভদ্রলোককে আমার কাছে আসতে বল।
পুলিশরা এবার ভদ্রলোকের খোঁজ করতে লাগল। জেভার্ত বলল, কোথায় সে?
কিন্তু ঘরের মধ্যে কোথাও তাকে দেখা গেল না।
বন্দি মঁসিয়ে লেবলাঁ বা আর্বেন ফেবার চলে গেছে। দরজার কাছে পাহারা ছিল। কিন্তু খোলা জানালার কাছে কোনও পাহারা ছিল না। মঁসিয়ে লেবার পায়ের বাধন খুলে দিলে সে ভিড়ের মধ্যে পুলিশদের কর্মব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে জানালার কাছটা অন্ধকার থাকায় সেই দিকে পালিয়ে যায়। দড়ির মইটা জানালায় তখনও লাগানো ছিল। একজন পুলিশ জানালার ধারে গিয়ে উঁকি মেরে দেখল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। জেভার্ত বলল, লোকটা দেখছি সব থেকে পাকা শয়তান।
.
২২.
এই ঘটনার পরের দিন সন্ধের সময় একটি ছেলে পন্ত দ্য অস্টারলিৎস থেকে গর্বোর ব্যারাকবাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল। মাদাম বুগনল সদরদরজার সামনে বসে ছিল। ছেলেটা তার কাছে এসে বলল, আমি ভেবেছিলাম একটা বড় কুকুর।
কুকুর বলায় বুড়ি বুগনল রেগে গিয়ে বলল, একটা খুদে রাক্ষস। আমি দাঁড়িয়ে থাকলে তোর বুকে পা দিতাম।
ছেলেটা বলল, আমি তা হলে ঠিকই ভেবেছি।
ছেলেটা এবার বাড়ির সদরদরজাটা বন্ধ দেখে দরজায় লাথি মারতে লাগল। মাদাম বুগনল ব্যস্ত হয়ে বলল, এ কি করছিস রে ছোঁড়া? ভালো দরজাটা ভাঙবি নাকি?
এতক্ষণে রাস্তার আলোয় ছেলেটার মুখটা দেখতে পেয়ে বুগলন বলল, ও তুই? পাজি ছোঁড়া কোথাকার!
ছেলেটা বলল, তুমি বুড়ি? নমস্কার মাদাম বুগ–আমি বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। মাদাম বুগনল বলল, বাড়িতে কেউ নেই।
ছেলেটা বলল, আমার বাবা কোথায়?
জেলে।
আমার মা কোথায়?
সেন্ট লাজারেতে।
আমার দিদিরা?
ম্যাদেলোনেত্তেতে আছে।
ছেলেটা তখন শিস দিয়ে বলল, ঠিক আছে।
এই বলে সে গান করতে করতে এলমগাছে ঘেরা রাস্তা দিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
৪.০১ জুলাই বিপ্লবের পর
চতুর্থ খণ্ড – প্রথম পরিচ্ছেদ
১.
জুলাই বিপ্লবের পর ১৮৩১ ও ১৮৩২ সাল দুটির এক বিশেষ তাৎপর্য আছে আমাদের ইতিহাসে। এই দুটি সাল যেন বিপ্লবের ফলাফলের দুটি দিককে উদঘাটিত করে লোকচক্ষে। সে ফলাফলের একদিকে আছে এক বিরাট পাহাড় আর একদিকে আছে এক গভীর খাদ। নানারকম আবেগানুভূতি আর তত্ত্বকথার মেঘঝড়ের মাঝে সমাজের যে জনগণ সব সভ্যতার ভিত্তিভূমি সে জনগণের বারবার আনাগোনা ঘটেছে আন্দোলন আর প্রতিরোধের মাধ্যমে।
বুর্বন রাজবংশের প্রতিষ্ঠায় সারা দেশের মধ্যে একটা ঝিমুনির ভাব আসে। অনেক বিপ্লব, যুদ্ধবিগ্রহ, বীরত্ব, আর জাতীয় উচ্চাভিলাষের মত্ততার পর শান্তি চায় দেশের ক্লান্ত জনগণ। এই সময় রাষ্ট্রদর্শনের প্রবক্তারা এগিয়ে আসেন তৎপর হয়ে। কিন্তু দেশের জনগণ অনাবিল শান্তি আর শৃঙ্খলা চায়। স্টুয়ার্ট যুগের ইংল্যান্ড যেমন একদিন লর্ড প্রোটেক্টরের অধীন প্রজাতন্ত্রের পর শান্তি চায় তেমনি ফরাসি জনগণ বিপ্লব ও সাম্রাজ্যশাসনের পর শান্তি চায়।
সম্রাট নেপোলিয়নের পতনের পর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত বুর্বন রাজতন্ত্র জনগণের দাবির প্রতি ছিল উদাসীন। তারা তখন রাজ্যশাসনের ঐশ্বরিক অধিকারে প্রমত্ত হয়ে উঠেছিল। তাদের এই বিশ্বাস ছিল যে রাজা অষ্টাদশ লুই-এর সনদে প্রজাদের অধিকার দানের যে প্রতিশ্রুতি ছিল সে অধিকার ইচ্ছা করলে ফিরিয়ে নিতে পারেন রাজা। প্রজারা বুঝতে পেরেছিল তাদের ন্যায়সংগত অধিকার দানের ব্যাপারে রাজাদের বিতৃষ্ণার অন্ত নেই।
বুর্বন রাজারা ভাবত সম্রাটের পতনের পর তাদের হাত খুব শক্ত হয়েছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি যে শক্তি সম্রাটকে অপসারিত করে তার পতন ঘটায় সে শক্তির হাতে তারা ক্রীড়নক মাত্র। তারা ভাবত যে অতীতে তাদের রাজশক্তির শিকড় গাড়া আছে সেই অতীত থেকেই তারা প্রাণরস আহরণ করে বেঁচে থাকবে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি যে অতীতের মধ্যে তাদের শিকড় গাঁথা আছে সে অতীত হল ফরাসি আর ফরাসি জাতি। তারা বুঝতে পারেনি যে গভীর আর শক্তিশালী শিকড়গুলো তাদের ধারণ করে রেখেছে সে শিকড় কোনও এক বিশেষ রাজবংশের অধিকার নয়, সে শিকড় হল সমস্ত ফরাসি জনগণের জাতীয় অধিকার।