হতাশ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে ছিল মেরিয়াস। হঠাৎ তার ঘরের মধ্যে একবার চোখ ফেরাতেই চাঁদের আলোয় তার টেবিলের উপর একটা কাগজ সে দেখতে পেল। এই কাগজের উপর আজ সকালে থেনার্দিয়েরের বড় মেয়েটি একটা কথা লিখেছিল, বাইরে দেখ, পুলিশ এসে গেছে।
মুহূর্তমধ্যে সব সমস্যার সমাধান খুঁজে পেল মেরিয়াস। তাকে এখন কী করতে হবে তা সে বুঝে নিল। সে এমন একটা কিছু করবে যাতে একই সঙ্গে হত্যার বলি আর হত্যাকারীকে বাঁচানো যাবে। মেরিয়াস কাগজটা কুড়িয়ে নিয়ে একটা ছোট ঢেলা দিয়ে মুড়িয়ে পার্টিশানের ফাঁক দিয়ে এমনভাবে পাশের ঘরে ফেলে দিল যাতে সেটা ঘরের মাঝখানে মেঝের উপর পড়ল।
ঠিক সময়েই কাগজটা ফেলেছিল মেরিয়াস। থেনার্দিয়ের তখন তার সব উৎকণ্ঠা ঝেড়ে ফেলে ছুরি হাতে বন্দির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল এমন সময় তার স্ত্রী তাকে বলল, কী একটা জিনিস পড়ল।
থেনার্দিয়ের বলল, কী বলছ তুমি?
তার স্ত্রী কাগজটা কুড়িয়ে তার স্বামীর হাতে দিল।
থেনার্দিয়ের বলল, কী করে এল এটা?
জানালা দিয়ে নিশ্চয়।
বিগ্রেনেল বলল, হ্যাঁ, ঠিক তাই। আমি দেখেছি।
থেনার্দিয়ের তাড়াতাড়ি কাগজটা খুলে পড়ে ফেলল বাতির আলোয়। পড়ার পর সে বলল, এটা এপোনিনের হাতের লেখা। হা ভগবান!
সে স্ত্রীকে ডেকে কাগজটা পড়ে শোনাতে লাগল। তার পর বলল, জানালায় মইটা লাগাও। ইঁদুরটাকে ফাঁদে ফেলে রেখে আমাদের এখনি পালাতে হবে।
তার স্ত্রী বলল, ওর গলা না কেটেই?
সময় নেই।
বিগ্রেনেল বলল, কিন্তু কী করে পালাব আমরা?
থেনার্দিয়ের বলল, এপোনিনে যা লিখেছে তাতে বোঝা যায় বাড়ির পাশে জানালার নিচে কোনও পাহারা নেই।
মুখোশপরা লোকটা তার হাত দিয়ে তিনবার তালি দিল। এর দ্বারা সব লোককে সতর্ক করে দিল। যারা তখন বন্দিকে ধরে ছিল তারা তাকে ছেড়ে দিল। একজন দড়ির মইটা খুলে জানালায় লাগিয়ে দিল। থেনার্দিয়ের তার স্ত্রীকে ডেকে আগে মইয়ে উঠতে যেতেই বিগ্রেনেল তার জামার কলারটা ধরল। বলল, এত তাড়াতাড়ি আগে গেলে হবে না। আমরা আগে যাব।
অন্য সব লোকরা বলল, আমরা আগে যাব।
থেনার্দিয়ের তাদের বলল, কেন ছেলেমানুষি করে বৃথা সময় নষ্ট করছ?
তখন একজন বলল, তা হলে কে আগে যাবে তার জন্য লটারির ব্যবস্থা করা হোক।
থেনার্দিয়ের আবার বলল, পুলিশ দূরে নেই। আইন আমাদের তাড়া করছে। আর তোমরা লটারি করে সময় নষ্ট করবে?
এমন সময় দরজার কাছে এক গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, তোমরা দেখছি আমার টুপিটা ধার করতে চাও।
সবাই সচকিত হয়ে দেখল, জেভার্ত দাঁড়িয়ে আছে। সে তার টুপিটা খুলে হাতে নিয়ে হাসছিল।
.
২১.
রাত্রি নামার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ইন্টপেক্টর জেতার্ত তার লোকজন নিয়ে বাড়িটার সামনের দিকে গাছের আড়ালে লুকিয়ে সংকেতের অপেক্ষা করতে থাকে। পেনার্দিয়েরের দুই মেয়েকে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাদের ধরতে গিয়ে দেখে বড় মেয়েটা পালিয়ে গেছে। তাই সে ছোট মেয়ে আজেলমাকে ধরে। সে বাড়ির সামনে কয়েকবার ঘোড়ার গাড়ি যাতায়াত করতে দেখে। বাড়িতে যেসব লোক ঢোকে তাদের সে চিনত। তাতে তার সন্দেহ হয়। তার পর গুলির কোনও আওয়াজ না পেয়ে মেরিয়াস তাকে সদরদরজার যে চাবিকাঠি দিয়েছিল তাই দিয়ে দরজা খুলে সে অবশেষে বাড়িতে ঢুকে পড়ে।
পুলিশ দেখেই সাতজন ভয়ঙ্কর চেহারার লোক তাদের ফেলে দেওয়া অস্ত্রগুলো আপন আপন হাতে তুলে নিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়। তাদের হাতে কুডুল-দা প্রভৃতি অস্ত্র ছিল। থেনার্দিয়ের তার ছুরিটা ঘোরাতে থাকে। তার স্ত্রী একটা পাথর কুড়িয়ে নেয়।
জেতার্ত আবার টুপিটা মাথায় দিয়ে ঘরের মধ্যে দু-পা এগিয়ে এসে শান্ত কণ্ঠে বলল, ব্যাপারটা বোঝ। তোমরা জানালা দিয়ে পালাতে পারবে না। বরং দরজা দিয়ে পালানোটা কম কষ্টকর হবে। তবে তোমরা সংখ্যায় সাতজন আর আমরা সংখ্যায় আছি পনেরো জন। সুতরাং বুদ্ধি-বিবেচনা করে কাজ করাই ভালো।
বিগ্রেনেল তার পিস্তলটা বার করে থেনার্দিয়ের হাতে দিয়ে চুপি চুপি বলল, আমি জেভাৰ্তকে গুলি করতে পারি না। তুমি পারো তো করো।
থেনার্দিয়ের বলল, আমি করব।
জেতার্ত তখন থেনার্দিয়েরের কাছ থেকে মাত্র তিন পা দূরে ছিল। সে জেতার্তকে লক্ষ্য করে পিস্তলটা তুলে ধরল।
জেভার্ত বলল, কোনও লাভ হবে না। ওতে গুলি নেই।
থেনার্দিয়ের পিস্তলের ঘোড়া টিপল, কিন্তু গুলি বার হল না।
জেভার্ত বলল, আমি তো আগেই বলেছিলাম।
বিগ্রেনেল তার হাতের দা-টা ফেলে দিয়ে জেভার্তকে বলল, তুমি হচ্ছ শয়তানের রাজা। আমি আত্মসমর্পণ করলাম। তবে আমাকে জেলে রাখার সময় তামাক খাবার অনুমতি দিতে হবে।
জেভার্ত বলল, ঠিক আছে। তোমার দেখছি বুদ্ধি আছে। আর বাকি সবাই? বাকি সবাই ঘাড় নেড়ে আত্মসমর্পণ করতে চাইল।
এমন সময় সশস্ত্র পুলিশবাহিনী ঘরে ঢুকল। জেতার্ত তাদের হুকুম দিল, ওদের হাতে হাতকড়া লাগাও।
এদিকে থেনার্দিয়েরের স্ত্রী তখন জানালার ধারে একটা বড় পাথর হাতে দাঁড়িয়ে পুলিশদের বলল, কই এস দেখি।
থেনার্দিয়ের তার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন এক দানবী একটা পাথর ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।
পুলিশরা দরজার কাছে সরে গেল পাথরের ভয়ে। তাদের ভয় দেখে থেনার্দিয়েরের স্ত্রী বলল, কাপুরুষ শূকরী কোথাকার!