থেনার্দিয়ের একটু থেমে আবার বলল, আমার স্ত্রী এসে যেমনি খবর দেবে লার্ক আসছে, অমনি আপনার সব বাঁধন খুলে দেওয়া হবে এবং আপনি ওই বিছানায় ঘুমোতে পারবেন। সুতরাং দেখছেন, আমাদের কোনও কুমতলব নেই।
মেরিয়াসের মনটা এতদূর খারাপ হয়ে গেল যে তার হৃৎস্পন্দন থেমে গেল। মেয়েটিকে তা হলে এখানে আনা বা রাখা হবে না, অন্য কোনও অজানা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে। এখন সে বুঝতে পারল সব। এখন কি সে তা হলে পিস্তলের গুলি করে পুলিশের হাতে এইসব শয়তানদের ধরিয়ে দেবে? কিন্তু তা হলে যে লোকটা মেয়েটিকে আনতে যাবে সে মুক্ত রয়ে যাবে এবং সে মেয়েটির ক্ষতি করতে পারে। পেনার্দিয়ের সেই কথাই বলছে। এখন তার পিতার আদেশ নয়, তার প্রেমাস্পদের চিন্তাই তার ডান হাতটা যেন ধরে রাখল, তাকে গুলি করতে দিল না।
সময় কেটে যেতে লাগল। প্রতিটি মুহূর্তে তার সংকট ঘনীভূত হয়ে উঠতে লাগল। সে মরিয়া হয়ে এই সংকট থেকে মুক্তির কোনও সম্ভাবনা বা আশার আলো দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু তা না পাওয়ায় তার অন্তরের আলোড়ন বেড়ে যেতে লাগল। ঘরখানার সমাধিভূমিসুলভ নীরবতার মাঝে তার অন্তরের এই আলোড়ন বিপরীতক্রমে প্রকট হয়ে উঠছিল তার কাছে।
সহসা ঘরের দরজাটা খুলে গেল। থেনার্দিয়ের বলল, এসে গেছে।
পরমুহূর্তেই থেনার্দিয়েরের স্ত্রী তার জানুর উপর হাত চাপড়ে চিৎকার করে বলে উঠল, ভুল ঠিকানা। তার সঙ্গের লোকটা হাতের কুডুলটা তুলঁল।
থেনার্দিয়ের আশ্চর্য হয়ে বলল, ভুল ঠিকানা!
হ্যাঁ, ১৭ র্যু সেন্ট ডোমিনিকে মঁসিয়ে আর্বেন ফেবার বলে কেউ থাকে না। বাড়িটা বড় এবং অনেক লোক আছে। তারা ও নামে কাউকে চেনে না। বাড়ির দারোয়ান ও তার স্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হল। বুড়োটা তোমাকে বোকা বানিয়েছে মঁসিয়ে থেনার্দিয়ের। তুমি খুব ভালো লোক কি না। আমি হলে ওর মুখটা ছিঁড়েখুঁড়ে দিতাম। ওর মেয়ের আসল ঠিকানা না দেওয়া পর্যন্ত ওকে আগুনের হেঁকা দিতাম। কী করে টাকা বের করতে হয় আমি জানি। কিন্তু তোমরা তো আমার বুদ্ধি নেবে না।
মেরিয়াস হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মেয়েটির নাম লার্ক বা আরসুলা যা-ই হোক, সে তা হলে নিরাপদে আছে।
তার স্ত্রী যখন রাগে চেঁচামেচি করে বেড়াচ্ছিল থেনার্দিয়ের তখন টেবিলের ধারে একটা চেয়ারে বসল। সে তার ডান পা-টা নাড়তে নাড়তে জ্বলন্ত কয়লাভরা কড়াইটার পানে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর সে বন্দির দিকে তাকিয়ে ভয়ঙ্করভাবে বলল, ভুল ঠিকানা। এতে তোমার কী লাভ হবে?
বন্দি বলল, সময় পাব।
এই বলে সে হাতের বাঁধনগুলো সরিয়ে দিল। সে বাঁধনগুলো আগে থেকে কাটা ছিল। তখন শুধু তার একটা পা বাঁধা ছিল বিছানার খাটের সঙ্গে।
হঠাৎ বন্দি বিছানা থেকে এক লাফে কড়াইটা থেকে উত্তপ্ত লাল বাটালিটার কাঠের বাট ধরে তাদের সামনে ভয়ঙ্করভাবে দাঁড়াল। থেনার্দিয়েরের স্ত্রী ও অন্য লোকেরা স্তম্ভিত হয়ে গেল।
মঁসিয়ে লেবলাঁর পকেটে ছোট একটা করাত ছিল। জেলের কয়েদিরা পালাবার জন্য এই ধরনের করাত কাছে রাখে। পরে পুলিশ ঘরটার মধ্যে এটা পড়ে থাকতে দেখতে পায়। সেই করাত দিয়ে সে তার হাতের বাঁধন কেটে দেয়। কিন্তু পায়ের বাঁধনটা কাটতে পারেনি সে।
বিগ্রেনেল বিস্ময়ের ভাবটা কাটিয়ে ওঠার পর থেনার্দিয়েরকে বলল, চিন্তার কারণ নেই। ওর একটা পা এখনও বাধা আছে।
বন্দি এবার ওদের বলতে লাগল, তোমরা বোকা। আমার জীবন খুব একটা মূল্যবান নয়। আমাকে কিছু লেখানো বা বলানোর চেষ্টা করে লাভ হবে না। আমি কিছু লিখব না বা বলব না। এই দেখ –এই বলে তপ্ত লাল বাটালির ধারালো দিকটা তার বাঁ হাতের উপর এক জায়গায় বসিয়ে দিল। তাতে হাতের কিছুটা চামড়া পুড়ে গেল। মেরিয়াস তা দেখে ভয়ে অভিভূত হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে যারা ছিল সেই দুবৃত্তগুলোও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তা দেখতে লাগল। কিন্তু বন্দির মুখের শান্ত ভাবের কোনও পরিবর্তন হল না। কোনও ঘৃণা বা বেদনার চিহ্ন ফুটে উঠল না। মহান চরিত্রের লোকদের মধ্যে দেহগত যন্ত্রণা তাদের আত্মাকে উন্নত করে।
সে বলল, যত সব বোকা কোথাকার, আমাকে ভয় করার কিছু নেই। দেখলে, আমি তোমাদের ভয় করি না। সে এবার বাটালিটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তার পর বলল, এবার তোমরা আমাকে নিয়ে যা খুশি করতে পার।
থেনার্দিয়ের তার লোকদের বলল, ওকে ধরে ফেল।
দুটো লোক সঙ্গে সঙ্গে বন্দির দুটো কাঁধ ধরে ফেলল। মুখোশপরা লোকটা তার। সামনে ঘুষি পাকিয়ে এমনভাবে দাঁড়াল যাতে দরকার বুঝলে ঘুষি মেরে তার মুখটা ভেঙে দিতে পারবে।
মেরিয়াস দেখল ঘরের মধ্যে সকলে চুপি চুপি নিজেদের মধ্যে কী সব বলাবলি করছে।
একজন বলল, একটা কাজ করতে হবে—
ওরা গলাটা কেটে দাও।
হ্যাঁ, ঠিক তাই।
থেনার্দিয়ের তার স্ত্রীর সঙ্গে কী পরামর্শ করতে লাগল। তার পর ধীর পায়ে টেবিলের ধারে গিয়ে ড্রয়ার থেকে সেই বড় ছুরিটা বার করল।
মেরিয়াসের হাতটা পিস্তলের বাঁটের উপর ছিল। তার উভয়সংকট চরমে উঠল। এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তার দ্বিধাবিভক্ত বিবেকের দুটি কণ্ঠস্বর তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করছিল তার মধ্যে। একটি কণ্ঠস্বর তাকে তার পিতার ইচ্ছা পূরণ করতে বলছিল আর একটি কণ্ঠস্বর বন্দিকে বাঁচাতে বলছিল। দুটি পরস্পরবিরুদ্ধ নীতির দ্বন্দ্বে তার অন্তর। ক্ষতবিক্ষত ও বেদনায় অভিভূত হয়ে উঠছিল। তার কেবলি মনে হচ্ছিল শেষ মুহূর্তে এমন কিছু একটা ঘটবে যাতে বিবদমান দুটি পক্ষের মধ্যে মিলন ঘটবে। কিন্তু আর অপেক্ষা করার মতো সময় নেই। কিছু একটা করতে হবে। থেনার্দিয়ের ছুরি হাতে বন্দির সামনে কয়েক পা দূরে ইতস্তত করছিল।