এরপর হঠাৎ সে মতের পরিবর্তন করল। বলল, না, শেষের লাইনটা কেটে দিন। এতে তার মনে সন্দেহ জাগতে পারে। এবার সই করুন। আপনার নাম কী?
মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, কার নামে চিঠিটা দেওয়া হবে?
আপনার মেয়েকে। আমি তো আগেই বলেছি।
মঁসিয়ে লেবলাঁ মেয়ের কোনও নাম চিঠির উপর লিখল না।
থেনার্দিয়ের বলল, ঠিক আছে সই করুন। আপনার নাম কী যেন?
আর্বেন ফেবার।
থেনার্দিয়ের বিড়ালসুলভ চাতুর্যের সঙ্গে তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে মঁসিয়ে লেবলাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া রুমালটা বার করে দেখল তাতে ইউ, এফ নামের এই অক্ষর দুটো সেলাই করা আছে।
সেটা দেখে থেনার্দিয়ের বলল, ঠিক আছে। ইউ, এফ–মানে আর্বেন ফেবার। ঠিক আছে। সই করুন, ইউ. এফ।
বন্দি তাই করল।
থেনার্দিয়ের বলল, এবার চিঠিটা আমাকে দিন। আমি মুড়ে দেব।
চিঠিটা মুড়ে সে বলল, ঠিক আছে, খুব ভালো। এবার চিঠির উপরে লিখুন, ম্যাদময়জেল ফেবার। এবার আপনার ঠিকানাটা লিখুন। আশা করি আপনি আপনার নাম ভুল বলেননি, ঠিকানাটাও ভুল বলবেন না। আপনার বাসা নিশ্চয় খুব একটা দূরে হবে না। কারণ সেন্ট জ্যাক চার্চে আপনারা প্রার্থনা করতে যান। তবে রাস্তার নামটা আমি জানি না।
বন্দি মঁসিয়ে লেবলাঁ কিছুক্ষণ ভেবে চিঠিটার উপরে লিখল, ম্যাদময়জেল ফেবার অফ আর্বেন ফেবার, ১৭ র্যু সেন্ট ডোমিনিক দ্য এলফার।
এবার চিঠিটা মঁসিয়ে লেবলাঁ’র হাত থেকে কেড়ে নিল থেনার্দিয়ের এক উত্তপ্ত উত্তেজনার সঙ্গে। তার পর তার স্ত্রীকে বলল, এই নাও চিঠি। তোমাকে কী করতে হবে তা জান। নিচে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এখনি চলে যাও এবং যত তাড়াতাড়ি পার ফিরে আসবে।
এবার কুডুলহাতে লোকটাকে সে বলল, তুমি তোমার মুখোশটাকে খুলে রেখেছ। তুমি গাড়িতে ওর সঙ্গে যাও। তুমি জান, গাড়িটা কোথায় আছে।
তার স্ত্রী আর লোকটা ঘর থেকে তখনি বেরিয়ে গেল। থেনার্দিয়ের তার স্ত্রীকে আবার ডেকে বলল, চিঠিটা যেন হারিয়ে না বা হাতছাড়া করো না কিছুতেই। মনে রাখবে এই চিঠিটার দাম ছয় লক্ষ ফ্রাঁ।
তার স্ত্রী বলল, ঠিক আছে। ভাবনার কোনও কারণ নেই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরে বাড়ির নিচে গাড়ি ছাড়ার শব্দ পেল তারা। থেনার্দিয়ের বলল, খুব ভালো। ওরা সময় নষ্ট না করে রওনা হয়ে গেছে। তার মানে পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসবে। সে এবার আগুনের কাছে বসে পা দুটো সেঁকতে লাগল। বলল, আমার পা একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে! বন্দি আর থেনার্দিয়েরকে ধরে মোট পাঁচজন লোক ছিল ঘরের মধ্যে। যে লোকগুলো ছিল তাদের মুখগুলো কালিমাখা ছিল বলে তাদের দেখে কয়লাখনির শ্রমিক বা রাক্ষস বলে মনে হচ্ছিল। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল অপরাধটাই তাদের পেশা। তাই এই পরিস্থিতিতে নির্বিকারভাবে এক জায়গায় জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিল। বিরাট গোলমালের পর একেবারে শান্ত হয়ে পড়েছিল ঘরখানা। শুধু ঘুমন্ত মাতাল লোকটার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছিল না। বাতির কম্পিত আলোয় ঘরের লোকগুলোর ছায়া পড়েছিল দেয়ালে।
কিন্তু ঘরখানার আপাতস্তষ্ক আবহাওয়াটা মেরিয়াসের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছিল। থেনার্দিয়েরের কথাবার্তা মঁসিয়ে লেবলাঁ ও তার মেয়ে সম্বন্ধে রহস্যটার সমাধান করার পরিবর্তে আরও নিবিড় করে তুলেছিল সেটাকে। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারল রুমালে সেলাই করা ইউ. এফ অক্ষর দুটোর অর্থ হল আরসুলা নয়, আর্বেন ফেবার।
এই ভয়ঙ্কর কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে মেরিয়াস সেখানে যেমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। সেইখানে তেমনিভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। সে নড়তে নড়তে বা কোনও কিছু ভাবতে পর্যন্ত পারছিল না। যে ঘটনা কিছু আগে সে ঘটতে দেখেছে সে ঘটনা যেন তার সর্বাঙ্গ অসাড় করে দিয়েছে। এরপর আবার কী হয় তা সে দেখতে চায়। সে এখন কী করবে তা সে স্থির করতে পারছিল না।
সে ভাবল মেয়েটি আসলে কে, সে তার সেই আকাক্ষিত প্রেমিকা কি না তা একটু পরেই সে এলে দেখা যাবে। থেনার্দিয়েরের স্ত্রী তাকে নিয়ে আসবে। সে যদি এসে বিপদে পড়ে তা হলে আমি আমার জীবন দিয়েও তাকে রক্ষা করব। কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না বা কোনও বাধা আমি মানব না।
আধঘণ্টা কেটে গেল। থেনার্দিয়ের তার কুটিল চিন্তার মধ্যে ডুবে গেল। বন্দি চুপচাপ বসে ছিল। হঠাৎ থেনার্দিয়ের বন্দিকে বলতে লাগল, আমার স্ত্রী ফিরে আসবে এখনি। আমাদের একটু শুধু অপেক্ষা করতে হবে। আমার মনে হয় লার্কই আপনার মেয়ে। আপনার মেয়ে আপনারই থাকবে। আমার স্ত্রী তাকে আপনার চিঠিটা দেবে। আমি তাকে বলে দিয়েছি আপনার মেয়েকে যেন ভালোভাবে পোশাক পরার সময় দেয়। তা হলে সে কোনও সন্দেহ করবে না এবং সে আমার স্ত্রীর সঙ্গে ঠিক আসবে। তাকে অন্য গাড়িতে তুলে দিয়ে ওরা এসে আমাকে খবর দেবে। আপনার মেয়ের কোনও ক্ষতি করা হবে না। তাকে এখানে আনার পর এক নিরাপদ জায়গায় রেখে দেওয়া হবে এবং আপনি আমাদের দু লক্ষ ফ্রাঁ দিয়ে দিলেই তাকে আপনার হাতে তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু আপনি যদি আমাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করেন তা হলে সেটা খারাপ হবে আপনার মেয়ের পক্ষে। বুঝতে পারলেন?
বন্দি কোনও কথা বলল না। থেনার্দিয়ের আবার বলল, তা হলে আপনি দেখতে পাচ্ছেন, ব্যাপারটা খুবই সহজ-সরল। আপনি কিছু না করলে খারাপ বা কারও কোনও ক্ষতিই হবে না।