এইভাবে কথা বলার সময় মঁসিয়ে লেবলাঁর পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল থেনার্দিয়ের। তার ভাষা এবং শয়তানসুলভ নৈপুণ্য, কথা বলার সুচতুর ভঙ্গিমা, তার উদ্ধত অথচ অবদমিত আত্মাভিমান–তখন যদি কেউ দেখত তা হলে ভাবত থেনার্দিয়ের সত্যিই একজন যাজক হতে পারত।
থেনার্দিয়েরের কথাগুলো মঁসিয়ে লেবলাঁ সম্বন্ধে রহস্যটা ঘন করে তুলঁল আরও মেরিয়াসের মনে। সাধারণত এই অবস্থায় মানুষ যা করে তা না করে বাদি যা করল তা সত্যিই অদ্ভুত। আবার থেনার্দিয়ের তার এই এই অদ্ভুত আচরণ সম্বন্ধে যে মন্তব্য করল এক বিজ্ঞ কূটনীতিকের মতো, সে মন্তব্য মঁসিয়ে লেবলাঁ সম্বন্ধে এক রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠল। কিন্তু সে যাই হোক, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এক দল খুনির দ্বারা পরিবৃত হয়ে মঁসিয়ে লেবলাঁ যে এক নিষ্ক্রিয় ঔদাসীন্যের সঙ্গে যেভাবে থেনার্দিয়েরের প্রচণ্ড ক্রোধাবেগের অভিব্যক্তি এবং শান্তশীতল বিষোদ্গার নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে, তা তার মুখমণ্ডলকে এক বিষণ্ণ মহিমায় মণ্ডিত করে তুলেছে। এর থেকে বেশ বোঝা যায় তার আত্মা ভয় বা আতঙ্ক কাকে বলে তা জানে না। এক বিপজ্জনক পরিস্থিতিজনিত সব বিস্ময়কে স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে সে। পরিস্থিতি যত সংকটজনকই হোক না কেন, বিপদ যতই আসন্ন বা অপরিহার্য হোক না কেন, এক নির্ভীক নিরাসক্তির সঙ্গে তার সম্মুখীন হতে পারে সে।
সহসা উঠে পড়ল থেনার্দিয়ের। চুল্লির উপর জ্বলন্ত কয়লাভরা কড়াইটাকে আড়াল করে যে পর্দাটা টাঙানো ছিল সেটা সরিয়ে দিতে সেই কড়াইয়ের উপর যে লোহার বাটালিটা বসানো ছিল সেটা চোখে পড়ল। তার পর সে মঁসিয়ে লেবলাঁর সামনের চেয়ারটাতে আবার বসল। সে বলল, এবার আমরা একটা বোঝাপড়ায় আসতে পারি। আমি যে রেগে গিয়েছিলাম সেটা ঠিক হয়নি। আমার মাথা ঠিক ছিল না এবং আমি অনেক বাজে কথা বলেছি। যেমন আমি বলেছিলাম, যেহেতু আপনি লক্ষপতি সেইহেতু আমি অনেক টাকা চাই আপনার কাছ থেকে। কিন্তু সেটা কখনও যুক্তিসঙ্গত কথা নয়। আপনি যত ধনীই হন না কেন, আপনারও খরচ আছে। আপনাকে নিঃস্ব করা উদ্দেশ্য নয় আমার। আমি রক্তচোষা নই। আমি সেই ধরনের লোক নই যারা কোনও মানুষকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে এমন দাবি করে বসে, যা অযৌক্তিক ও হাস্যাস্পদ। আমি দু দিকই বজায় রেখে চলতে চাই। আমি শুধু আপনার কাছ থেকে দু লক্ষ ফ্রাঁ চাই।
মঁসিয়ে লেবলাঁ কোনও উত্তর দিল না। থেনার্দিয়ের বলে চলল, আমি আপনার প্রকৃত অবস্থার কথা জানি না। তবে জানি টাকা-পয়সার প্রতি আপনার কোনও মায়া নেই এবং আপনি গরিব-দুঃখীদের দান করার মতো অনেক ভালো কাজ করে থাকেন। সুতরাং আপনি এক দুস্থ পরিবারের পিতাকে দু লক্ষ ফ্ৰাঁ অবশ্যই দান করতে পারেন। আপনি একজন যুক্তিবাদী লোক এবং আপনি দেখতে পাচ্ছেন এ ব্যাপারে কয়েকজন ভদ্রলোককে সাহায্যকারী হিসেবে আনতে হয়েছে। এঁরা এ বিষয়ে সকলেই একমত হবেন যে আমি যা চাইছি সেটা মোটেই বেশি নয়।
তাতে কোনওরকমের মোটা ভাত মোটা কাপড়সহ আমার বাকি জীবনটা কেটে যাবে। আমি শুধু চাই দু লক্ষ ফ্রাঁ। আমি কথা দিচ্ছি, এই টাকা ছাড়া আর আমি কখনও কিছুই চাইব না আপনার কাছ থেকে, আপনার আর ভয়ের কিছু থাকবে না। আপনি হয়তো বলতে পারেন, এখন আপনার কাছে অত টাকা নেই। আমিও অত বোকা নই যে তা আশা করব। এখন আমি শুধু বলছি, আপনি আমার কথামতো একটা চিঠি লিখুন।
এখানে থামল থেনার্দিয়ের। কথা বলতে বলতে থেমে গিয়ে জ্বলন্ত কয়লাভরা কড়াইটার দিকে একবার চাইল। তার পর বলল, আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, আপনি লিখতে না জানার ভান করবেন না।
সে অদ্ভুত এক অর্থপূর্ণ হাসি হেসে টেবিলটা মঁসিয়ে লেবলাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে কাগজ-কলম বার করার জন্য ড্রয়ার খুলতেই তার মধ্যে একটা বড় ছুরি দেখা গেল। থেনার্দিয়ের একটা কাগজ মঁসিয়ে লেবলাঁ’র হাতে দিয়ে বলল, লিখুন।
বন্দি মঁসিয়ে লেবলাঁ এই প্রথম কথা বলল, আমার হাত বাঁধা থাকলে কী করে লিখব।
থেনার্দিয়ের বলল, তা বটে। মাপ করবেন।
সে বিগ্রেনেলকে বলল, ওঁর হাতের বাঁধন খুলে দাও।
মঁসিয়ে লেবলাঁ’র হাত দুটো মুক্ত হতে একটা কলম কালিতে ডুবিয়ে তার হাতে দিল থেনার্দিয়ের।
থেনার্দিয়ের বলল, শুনুন মঁসিয়ে, আপনি এখন সম্পূর্ণ আমাদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল। যদিও কোনও মানুষ আমাদের কবল থেকে আপনাকে উদ্ধার করতে পারবে না তথাপি আপনাকে দিয়ে এক অপ্রিয় কাজ করিয়ে নিতে দুঃখ হচ্ছে আমার। আমি আপনার নাম-ঠিকানা জানি না। কিন্তু আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, আপনি যে চিঠি লিখবেন সে চিঠি যে নিয়ে যাবে সে ফিরে না আসা পর্যন্ত আপনাকে বেঁধে রাখা হবে। এবার আমি যা বলছি লিখুন।
মঁসিয়ে লেবলাঁ কলমটা ধরল। পেনার্দিয়ের বলল, লিখুন, আমার প্রিয় কন্যা তুমি পত্রপাঠ এখানে চলে আসবে।
তার পরই চিঠির কথা বন্ধ করে বলল, আপনি কি ওকে ‘মেয়ে’ না ‘লার্ক’ বলে সম্বোধন করেন?
মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না।
থেনার্দিয়ের বলল, ও কিছু মনে করবেন না। ঠিক আছে লিখুন,… তুমি এখনি চলে আসবে। তোমাকে আমার খুবই প্রয়োজন। পত্রবাহক তোমাকে এখানে নিয়ে আসবে। তোমার ভয়ের কিছু নেই।