থেনার্দিয়ের বলল, তুমি তোমার মুখোশটা খুলে রেখেছ কেন?
মঁসিয়ে লেবলাঁ এতক্ষণ থেনার্দিয়েরের প্রতিটি গতিভঙ্গি লক্ষ করে যাচ্ছিল। সে দেখল দলে মোট নয়জন লোক রয়েছে। থেনার্দিয়ের তার দিকে পেছন ফিরে দরজার কাছে দাঁড়ানো লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলতে লাগল। এই সুযোগে মঁসিয়ে লেবলাঁ তার সামনের টেবিল আর চেয়ারটা উল্টে দিয়ে এক মুহূর্তে জানালার ধারে চলে গেল। পালাবার জন্য জানালা দিয়ে উঁকি মেরে নিচে তাকাতে লাগল। কিন্তু দু জন লোক তাদের শক্ত হাত দিয়ে ধরে ফেলল তাকে। তাদের মধ্যে তিনজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল মঁসিয়ে লেবলাঁ’র উপর। থেনার্দিয়েরের স্ত্রী তার মাথার চুলগুলোকে ধরে ফেলল।
হইচই শুনে বারান্দায় অপেক্ষমাণ লোকগুলো ছুটে এল। যে বুড়ো লোকটা বিছানায় ঘুমোচ্ছিল সে একটা হাতুড়ি নিয়ে উঠে পড়ল। পানশাদ বা বিগ্রেনেল নামে লোকটা তার হাতের দা-টাকে ঘোরাতে লাগল।
মেরিয়াস আর সহ্য করতে পারল না। সে মনে মনে বলল, আমাকে ক্ষমা কর পিতা, তোমার কথা আমি রাখতে পারব না।
এই বলে সে পিস্তলের ঘোড়ায় হাত দিল। এমন সময় থেনার্দিয়ের বলল, ওকে কোনওরূপ আঘাত করো না।
বন্দির অবস্থা দেখে থেনার্দিয়েরের রাগের পরিবর্তে ধৈর্য বেড়ে গেল। তার মধ্যে যেন দুটো মানুষ ছিল একটা পশু আর একটা চতুর মানুষ। তার শিকার বা বন্দি মানুষটাকে বেকায়দায় ফেলে তাকে করায়ত্ত করার ব্যাপারে তার পাশবিক প্রবৃত্তিটা কাজ করছিল। কিন্তু যখন দেখল বন্দি লোকটা ঘুষি মেরে দু তিনজনকে ঘায়েল করে ফেলে দিল তখন তার মধ্যে চতুর মানুষটা প্রাধান্য লাভ করল। সে আবার বলল, ওকে আঘাত করো না।
কেউ বন্দিকে আঘাত না করায় মেরিয়াস গুলি করতে গিয়েও করল না। সে দেখতে লাগল এরপর কী হয়। সে ভাবল হয়তো শেষ মুহূর্তে কিছু একটা ঘটবে যার ফলে তার প্রেমাস্পদের পিতার প্রাণনাশ হবে না, আর তার পিতার রক্ষাকর্তাকেও মারতে হবে না।
এদিকে মঁসিয়ে লেবলাঁ সেই বুড়ো লোকটাকে একটা ঘুষি মেরে ফেলে দিল এবং আও দু জনকে ফেলে দিল। কিন্তু বাকি চারজন লোক তার হাত আর ঘাড়টা ধরে রইল। অর্ধ বিজেতা আর অর্ধ বিজিত অবস্থায় মঁসিয়ে লেবলাঁ একদল শিকারি কুকুর-পরিবৃত এক বনশুয়োরের মতো বসে রইল এক জায়গায়।
লোকগুলো বন্দিকে ধরে জানালার ধারে একটা বিছানায় বসাল। থেনার্দিয়েরের স্ত্রী তখনও মঁসিয়ে লেবলাঁ’র মাথার চুলগুলো ধরে ছিল।
থেনার্দিয়ের তার স্ত্রীকে বলল, তুমি ছেড়ে দাও, তোমার শাল ছিঁড়ে যাবে।
স্বামীর কথায় বন্দির মাথাটা ছেড়ে দিল থেনার্দিয়ের-পত্নী।
থেনার্দিয়ের বলল, ওর পকেটগুলো খুঁজে দেখ কী আছে।
লোকগুলো বন্দির সব পকেট খুঁজে মাত্র ছ ফ্রাঁ আর রুমাল পেল। থেনার্দিয়ের বলল, টাকার কোনও প্যাকেট নেই?
একজন লোক বলল, হাতঘড়িও নেই।
মুখোশপরা লোকটা বলল, লোকটা চতুর এবং পুরনো পাপী।
থেনার্দিয়ের সেই দড়ির মইটা দিয়ে তার লোকদের বলল, ওকে ভালো করে বেঁধে রাখ। খাটের পায়ার সঙ্গে ওর পা দুটোকে বেঁধে দাও।
যে বুড়ো লোকটা মঁসিয়ে লেবলাঁ’র ঘুষি খেয়ে মড়ার মতো পড়েছিল তার দিকে তাকিয়ে থেনার্দিয়ের বলল, বুনায়েল কি মরে গেছে?
বিগ্রেনেল বলল, না, মদ খেয়ে ও মাতাল হয়ে আছে।
থেনার্দিয়ের বলল, ওকে সরিয়ে দাও।
কয়েকজন লোক বুনায়েলকে ধরাধরি করে ঘরের এককোণে লোহার যন্ত্রপাতিগুলোর গাদায় শুইয়ে দিল। এরপর থেনার্দিয়ের বলল, শোন বাবেত, এত লোক এনেছ কেন? এত লোক তো আমাদের দরকার নেই।
বাবেত বলল, কী করব, ওরা ছাড়ল না, জোর করে এল।
এদিকে হাসপাতালের বিছানার মতো চারটে কাঠের খুঁটিওয়ালা যে বিছানাটায় মঁসিয়ে লেবলাঁকে বসানো হয়েছিল, থেনার্দিয়ের সেই বিছানাটার সামনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে অন্য লোকদের বলল, তোমরা একটু সরে যাও। আমি ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
পথনার্দিয়েরের এই আকস্মিক ভাবান্তর দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল মেরিয়াস। একটু আগে তার যে মুখখানায় প্রচণ্ড রাগে ফেনা ভাসছিল সে মুখে এখন এক শান্ত হাসি ফুটে উঠেছে। তার এই আশ্চর্য ভাবান্তর দেখে মেরিয়াসের মনে হল একটা বাঘ যেন হঠাৎ অ্যাটর্নি হয়ে গেছে।
শান্ত কণ্ঠে বলল থেনার্দিয়ের, শুনুন মঁসিয়ে, আপনি জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পালাতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাতে আপনার পা ভেঙে যেত। যাই হোক, এখন শান্তভাবে আমরা কিছু আলোচনা করতে পারি। তবে একটা কথা, তার আগে না বলে পারছি না। এত সব মারামারি আর গোলমালের মধ্যে আপনি একবারও চিৎকার করেননি।
কথাটা অস্বীকার করা যায় না। খুব বিচলিত হয়ে পড়লেও মেরিয়াস এটা লক্ষ করেছে। গোলমালের সময় মঁসিয়ে লেবলাঁ যে সব কথা বলেছে তা যথা সম্ভব শান্ত কণ্ঠে বলেছে। এমনকি সে যখন লোকগুলোর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে তখনও মুখে একটা কথাও বলেনি।
থেনার্দিয়ের বলল, আপনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে পারতেন। তা যদি করতেন আমরা তা হলে বিস্মিত হতাম না। আমরা আপনার গলা টিপে ধরিনি। কারণ আমরা জানি এ জায়গাটা এমনই যে এখানকার কোনও শব্দ বাইরে যায় না। এখান থেকে কেউ বোমা ছুঁড়লে বা গুলি করলে পুলিশরা ভাববে ওসব মাতালদের কাণ্ড। তবে কেন আপনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করেননি তার কারণ আমি জানি। কারণ আপনি জোরে চিৎকার করলে হয়তো পুলিশ আসত আর পুলিশ মানেই আইন। সেই আইনকে আপনি ভয় পান ঠিক আমরা যেমন আইন আর পুলিশকে ভয় পাই। এটা আমি অনেক আগে থেকে সন্দেহ করেছিলাম যে আপনার জীবনে গোপনীয় একটা ব্যাপার আছে। আমাদেরও ঠিক সেই অবস্থা। সুতরাং আলোচনার মাধ্যমে একটা বোঝাপড়ায় আসা যাক।