শ্বাস নেবার জন্য থামল থেনার্দিয়ের। সে হাঁপাচ্ছিল। তার বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছিল। এক হীন জয়ের পৈশাচিক আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে হয়ে উঠল তার চোখ দুটো। তাতে তার কাপুরুষোচিত দুষ্ট প্রকৃতিটা ফুটে উঠল। এইভাবে সে যেন তার জয়ের বস্তুকে জয় করতে চায়। বামন হয়ে সে দৈত্যের বুকে পা দিয়ে দাঁড়াতে চায়। একটা শেয়াল যেন রুগ্ণ ষাড়ের পাজরে কামড় দিতে চায়।
মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, আমি বুঝতে পারছি না তোমরা কী বলছ। তোমরা ভুল করছ। আমি একজন সামান্য গরিব লোক, লক্ষপতি তো দূরের কথা। আমি তোমাদের চিনি না। তোমরা হয়তো অন্য কারও সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছ।
থেনার্দিয়ের গর্জন করে উঠল, তুমি সেই এক কথা বলছে। তুমি স্মরণ করতে পারছ না? আমি কে সে সম্বন্ধে কোনও ধারণাই নেই।
মঁসিয়ে লেবলাঁ শান্তভাবে বলল, না, মোটেই না। তবে, তোমার প্রকৃতিটা আমি বুঝতে পেরেছি। বুঝেছি কী ধরনের মানুষ তুমি। তুমি একটি কাপুরুষ।
এই অবস্থায় সে যেভাবে ঠাণ্ডা মাথায় কথাগুলো বলল তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
‘কাপুরুষ’ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে থেনার্দিয়ের-পত্নী লাফিয়ে উঠল। থেনার্দিয়ের একটা চেয়ার ধরে গর্জন করে বলল, তুমি যেখানে আছে সেখানেই থাক।
এরপর সে মঁসিয়ে লেবলাঁর দিকে ফিরে বলতে লাগল, কাপুরুষ, তাই না? তোমরা ধনীরা আমাদের মতো গরিবদের এই কথাই বলবে। আমি ব্যবসায় ব্যর্থ হয়েছি, লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছি। আমার পকেটে পয়সা নেই–আমি কাপুরুষই বটে। তোমরা দামি জুতো আর আর্কবিশপদের মতো দামি কোট পর। তোমরা ভালো বাড়িতে থাক যে বাড়িতে দারোয়ান থাকে। তোমরা খবরের কাগজে আবহাওয়ার সংবাদ পড়ে দামি থার্মোমিটারে তাপমাত্রা দেখ। আর আমরা নিজেরাই থার্মোমিটার। আমাদের কোনও থার্মোমিটারের দরকার হয় না। ঠাণ্ডায় আমাদের দেহের রক্ত হিম হয়ে যায়। এবং আমরা তখন বলি, ঈশ্বর নেই। আমার তোমরা আমাদের এই শুয়োরের খোয়াড়ে এসে আমাদের কাপুরুষ বল। কিন্তু আমরা যা-ই হই না কেন, তোমাদের চিবিয়ে খাব, তোমাদের গায়ের মাংস খাব। তবে শুনে রাখ পালকের পোশাকপরা লক্ষপতি, আমিও একদিন সভাবে ব্যবসা করতাম, আমি ছিলাম এক লাইসেন্সধারী হোটেল মালিক। আমার ভোট দেবার অধিকার ছিল, আমি ছিলাম এক সম্ভ্রান্ত নাগরিক।
এবার সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে লোকগুলোকে লক্ষ করে বলল, উনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন আমি একজন পকেটমার।
থেনার্দিয়ের আবার মঁসিয়ে লেবলাঁর দিকে ঘুরে বলল, শুনে রাখ পরোপকারী বন্ধু, আমি যে-সে নই, চোরও নই। আমি ফ্রান্সের এক ভূতপূর্ব সৈনিক। আমার একটা মেডেল পাওয়া উচিত ছিল। আমি ওয়াটারলুতে যুদ্ধ করি এবং আমি একজন সেনাপতিকে বাঁচাই যিনি ছিলেন একজন কাউন্ট উপাধিধারী। তিনি তার নাম বলেছিলেন, কিন্তু আমি তা শুনতে পাইনি। তাঁর নাম আর ঠিকানাটা জানলে আমার উপকার হত। যে ছবিটা আমি দেখিয়েছি সেটা ডেভিডের আঁকা। শিল্পী আমাকে তাতে অমর করে রেখেছে। আমাকে যুদ্ধরত অবস্থায় দেখানো হয়েছে। আমি সেই জেনারেলকে পিঠে করে গোলাগুলির মধ্য দিয়ে নিরাপদ জায়গায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। এই হল আমার কাহিনী। অবশ্য সে জেনারেল আমার কোনও উপকার করেননি। তিনিও আপনাদের মতো। যাই হোক, আমার হাতে প্রমাণ আছে। আমি হচ্ছি ওয়াটারলু যুদ্ধের একজন নির্ভীক সৈনিক। যাই হোক, এখন আমি আমার পরিচয় দিলাম। এবার কাজের কথায় আসা যাক। আমার এখন টাকা চাই।
মেরিয়াস তার আবেগানুভূতিকে সংযত করার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছে। সে আবার কান পেতে পাশের ঘরের সব কথাবার্তা শুনতে লাগল। সে বুঝতে পারল এই লোকই হচ্ছে তার বাবার চিঠিতে উল্লিখিত থেনার্দিয়ের। এই থেনার্দিয়ের আবার তার বাবার অকৃতজ্ঞতার জন্য অভিযোগ করল। থেনার্দিয়েরের প্রতিটি আবেগে উচ্ছ্বাসে, তার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিতে, তার জ্বলন্ত চোখের উত্তাপে, দুঃখকষ্টের সঙ্গে সঙ্গে তার পাপপ্রবৃত্তির নির্লজ্জ অভিব্যক্তিতে একই সঙ্গে এক ধ্বংসাত্মক জীবন আর তার সঙ্গে সঙ্গে এক মর্মস্পশী সত্যের আবেদন ছিল।
থেনার্দিয়ের যে ছবিটা দেখিয়ে মঁসিয়ে লেবলাঁকে কিনতে বলে, আসলে সে ছবিটা তার নিজেরই আঁকা। ছবিটা সে মঁতফারমেলের হোটেলের সামনে টাঙিয়ে রাখত। থেনার্দিয়ের তখন ছবিটার সামনে না থাকায় মেরিয়াস এবার ছবিটাকে ভালো করে দেখতে পেল। সে দেখল ছবিতে সত্যিই যুদ্ধক্ষেত্রের একটা দৃশ্য চিত্রিত হয়েছে। সে দৃশ্যে একজন বীর সার্জেন্ট একজন অফিসারকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ছবিটাতে তার বাবা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মেরিয়াসের মনে হল, সহসা অনাবৃত উন্মুক্তদ্বার এক সমাধিগহ্বর থেকে তার পিতার পুনরথিত প্রেতমূর্তি উঠে এসেছে। সে যেন ওয়াটারলুর যুদ্ধক্ষেত্রের কামানের গর্জন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। মনে হল মোটা হাতে স্থূলভাবে আঁকা তার পিতার রক্তাক্ত দেহটা সহসা জীবন্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
থেনার্দিয়ের তখন হাঁফ ছেড়ে কড়াভাবে মঁসিয়ে লেবলাঁকে বলল, আমরা আমাদের কাজ করার আগে তোমার কিছু বলার আছে?
মঁসিয়ে লেবলাঁ কোনও কথা বলল না।
তখন দরজার সামনে কুড়ুল হাতে একটা লোক মোটা গলায় বলল, যদি কোনও কাটাকাটি করার কাজ থাকে তো আমি আছি।