জনদ্ৰেত্তে তার কাছে আরও এগিয়ে গিয়ে হিংস্র জন্তুর মতো মুখটা বাড়িয়ে বলল, আমার নাম মঁসিয়ে ফাবান্ত বা জনদ্ৰেত্তে নয়, আমি হচ্ছি মঁতফারমেলের হোটেলমালিক থেনার্দিয়ের। শুনতে পাচ্ছেন? এবার আমাকে চিনতে পারছেন না?
মৃদু কম্পনের একটা ছোট্ট ঢেউ খেলে গেল মঁসিয়ে লেবলাঁ’র মুখে। কিন্তু সে শান্তভাবে নরম সুরে বলল, না, চিনতে পারছি না।
কেউ যদি সেই মুহূর্তে মেরিয়াসের মুখপানে তাকাত তা হলে সে দেখতে পেত ভয়ে অভিভূত হয়ে উঠেছে সে মুখ। থেনার্দিয়েরের নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহটা এমনভাবে কেঁপে ওঠে যে পার্টিশানের দেয়াল ধরে না ফেললে পড়ে যেত সে। তার মনে হল কে যেন একটা তীক্ষ্ণ তরবারি ঢুকিয়ে দিয়েছে তার বুকের ভেতর। তার যে হাত পিস্তলটা ধরে গুলি করার জন্য উদ্যত হয়ে উঠেছিল সে হাতটা আপনা থেকে ঢলে পড়ল। আর একটু হলে পিস্তলটা পড়ে যেত মেঝের উপর। জনদ্ৰেত্তে তার আসল পরিচয়টা দিয়ে মঁসিয়ে লেবলাঁকে কাঁপাতে পারেনি, কিন্তু মেরিয়াসের অন্তরটাকে দীর্ণ বিদীর্ণ করে দিয়েছে। আমরা জানি এ পরিচয়ের মানে কী। মঁসিয়ে লেবলাঁ হয়তো এ নামের সঙ্গে পরিচিত না থাকতে পারে, কিন্তু মেরিয়াস এ নামের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত। তার বাবার কথাগুলো অন্তরে আজও গাঁথা আছে তার। তার বাবার একটা চিঠিতে লেখা ছিল, ‘থেনার্দিয়ের নামে একটি লোক আমাকে বাঁচিয়েছিল। আমার পুত্র কোনওদিন যদি তার দেখা পায় তা হলে সে তাকে সাহায্য করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।’ মেরিয়াসের কাছে এ কথা যেন এক ধর্মীয় আইন এবং আদেশ। মঁতফারমেলের হোটেলমালিক যে থেনার্দিয়েরকে সে কত খুঁজছে, যে থেনার্দিয়ের তার পিতার রক্ষাকর্তা, সে আসলে একজন দস্যু, নরঘাতক এবং এই মুহূর্তে এক জঘন্য অপরাধ করতে চলেছে। অদৃষ্টের পরিহাস এর থেকে নির্মম কখনও হতে পারে না। চার বছর ধরে মেরিয়াস তার ওপর চাপিয়ে চাপিয়ে ঋণের বোঝা থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য যাকে কত খুঁজে আসছে আজ তাকেই হয়তো জেলে বা ফাঁসির মঞ্চে পাঠাতে হবে। আজ তার পিতার রক্ষাকর্তাকে তাকেই শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু তা না করে সে কী করে থাকবে? কী করে সে নীরবে ও নিষ্ক্রিয়ভাবে এই জঘন্য অপরাধ ও অপকর্ম নিজের চোখে দেখবে, কী করে এ কাজ ঘটতে দেবে সে? কী করে একই সঙ্গে অপরাধী এবং যার ওপর অপরাধ করা হচ্ছে তাদের দু জনকে রক্ষা করবে? এই ধরনের দুষ্ট প্রকৃতির লোকের কাছে কোনও ঋণ থাকলে সে ঋণ কি সংগত বলে বিবেচিত হতে পারে? কোনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারল না মেরিয়াস। তার সর্বাঙ্গ শুধু কাঁপতে লাগল। এখন তারই ওপর নির্ভর করছে সব কিছু। যদি সে এখন পিস্তল থেকে গুলি করে তা হলে মঁসিয়ে লেবলাঁ বেঁচে যাবে, কিন্তু থেনার্দিয়ের ধ্বংস হবে। আর তা না হলে মঁসিয়ে লেবলাঁ মারা যাবে আর থেনার্দিয়ের পালিয়ে যাবে। কিন্তু মেরিয়াসকে কিছু একটা করতেই হবে। দু জনের একজনকে বাঁচাতেই হবে। সে কি তার পিতার শেষ ইচ্ছা পূরণ করে তার শপথ পালন করে এই অপকর্ম ঘটতে দেবে, নাকি পিতার আত্মার প্রতি প্রদত্ত শপথ ভঙ্গ করে মঁসিয়ে লেবলাঁকে বাঁচাবে? তার মনে হল দুটো কণ্ঠস্বর তার কানে এসে বাজছে–একটি কণ্ঠস্বর হল তার প্রেমাস্পদ সেই মেয়েটির যে তার পিতাকে বাঁচাবার জন্য কাতর মিনতি জানাচ্ছে তাকে আর একটি কণ্ঠস্বর হল তার পিতার যে থেনার্দিয়েরকে বাঁচাতে বলছে। তার মনে হল সে যেন ক্রমশই তার চেতনা ও সমস্ত বোধশক্তি হারিয়ে ফেলছে এবং তার হাঁটু দুটোর জোর কমে আসছে। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। তার চোখের সামনে যে নাটক অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে, অবিলম্বে তার গতি রোধ না করলে আর কোনও উপায় থাকবে না। মনে হল যেন এক প্রবল ঘূর্ণিবায়ু তাকে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে এখনি মূৰ্ছিত হয়ে পড়বে।
এদিকে থেনার্দিয়ের পাগলের মতো ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বাতিটা তাকের উপর জোরে নামিয়ে রেখে মঁসিয়ে লেবলাঁ’র কাছে এসে বলতে লাগল, অবশেষে আমি তা হলে তোমাকে পেয়ে গেছি। আমি তোমাকে ঠিক চিনেছি, কিন্তু তুমি আমাকে চিনতে পারনি। তুমিই কি একদিন খ্রিস্টোৎসবের সময় মঁতফারমেলে আমার হোটেলে এসে ফাঁতিনের মেয়েটাকে নিয়ে যাওনি? তোমার গাঁয়ে তখন কি একটা হলুদ রঙের কোট আর হাতে জামাকাপড়ের পুঁটলি ছিল না? মনে হচ্ছে ওঁর যেন দান করার একটা বাতিক আছে, উনি সবাইকে জামাকাপড় বিলিয়ে বেড়ান। উদারহৃদয় লক্ষপতি, তুমি তা হলে আমাকে চিনতে পারলে না? তোমাকে এবার মজা দেখাচ্ছি। তুমি মনে করেছ হাসপাতালের কিছু পুরনো পোশাক আর একটা ওভারকোট দিয়ে পার হয়ে যাবে!
থেনার্দিয়ের একটু থামল। তার মনে হল সে যেন তার ক্রোধের সব আবেগটুকু নিঃশেষে ঢেলে দিয়েছে। তার পর সে হঠাৎ টেবিলের উপর একটা ঘুষি মেরে বলল, উনি যেন কিছু জানেন না। ওঁর মুখে যেন মাখন গলে না!
এরপর মঁসিয়ে লেবলাঁ’র মুখটা ঘুরিয়ে বলতে লাগল, একদিন তুমি আমাকে হারিয়ে দিয়ে চলে যাও। তুমিই আমার সব দুঃখ-বিপর্যয়ের কারণ। মাত্র পনেরোশো ফ্রাঁ দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে যাও তুমি। সে আমার কাছে থাকলে আমি অনেক টাকা পেতাম এবং তাতে আমার জীবনটা ভালোভাবেই কেটে যেত। তার অনেক ধনী আত্মীয় ছিল। তার থেকে অনেক টাকা আমি পেয়েও ছিলাম। আমার হোটেল ভালো চলত না। যত সব বাজে খরিদ্দার মদ খেতে আসত প্রায় বিনা পয়সায়। দেনায় পড়ে গিয়েছিলাম আমি। সে থাকলে তার টাকায় আমি সব দেনা মিটিয়ে ফেলতাম একে একে। আমি কারবারের পুঁজিটাকেও খেয়ে ফেলতে বাধ্য হই। তুমি সেদিন আমাকে বনে খুব বোকা বানিয়েও যাও। বনে কোনও লোক ছিল না। তুমি আমার থেকে বেশি শক্তিশালী ছিলে। এবার আমার পালা। আমি তোমাকে বোকা বানাব। আমি বলেছিলাম আগামীকাল ৪ ফেব্রুয়ারি, বাড়িভাড়া মেটাতে হবে। কবে কোন তারিখ সেটাও তোমার জ্ঞান নেই। আর মাত্র ষাট ফ্রাঁ উনি ভিক্ষে দিতে এসেছেন। পুরো একশো ফ্ৰাও আনেননি। আজ এখন আমার বলতে ইচ্ছা করছে, সকালে তোমার পা চেটেছিলাম, রাত্রে তোমার হৃৎপিণ্ড কাটব।