সে উঠে গিয়ে দেয়ালের কাছ থেকে একটা ছবি তুলে আনল। বাতির আলোয় দেখা গেল সেটা সত্যিই একটা বড় ছবি। মেরিয়াস ছবিটাকে ভালো করে দেখতে পেল না। কারণ জনদ্ৰেত্তে তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। মেরিয়াস দেখল একটা প্ল্যাকার্ডের মতো পিচবোর্ডের উপর রঙ দিয়ে আঁকা একটা ছবি।
মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, এটা কিসের ছবি?
জনদ্ৰেত্তে বলল, ছবিটা দারুণ এবং খুব দামি। ছবিটাকে আমি এবং আমার মেয়েরা খুব ভালোবাসি। কিন্তু অবস্থার বিপাকে এটা বিক্রি করতে হবে আমায়।
মঁসিয়ে লেবলাঁ একটা অস্বস্তি বোধ করায় ছবিটা দেখতে দেখতে ঘরের চারপাশে তাকাতে লাগল। দেখল তখন ঘরে চারজন বাইরের লোক এসে ঢুকেছে। তিনজন বিছানায় বসেছে আর একজন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সবারই হাতগুলো অনাবৃত ছিল এবং মুখগুলো কালিমাখা ছিল। সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল। বিছানার উপর যারা বসে ছিল তাদের একজন চোখ বন্ধ করে অর্ধশায়িত অবস্থায় ছিল। তাকে মনে হচ্ছিল সে ঘুমোচ্ছে। তার মাথার চুলগুলো একেবারে সাদা ছিল। অন্য দু জন বয়সে যুবক। তাদের পায়ে জুতো বা চটি ছিল না।
মঁসিয়ে লেবলাঁ তাদের দেখছে দেখে জনদ্ৰেত্তে বলল, ওরা সবাই আমার বন্ধু এবং প্রতিবেশী। ওরা সবাই কারখানার ফার্নেসে কাজ করে বলে ওদের মুখগুলো ময়লা এবং কালিমাখা। ওদের কথা ভাববেন না স্যার। আমার ছবিটা আপনি কিনুন। আমার দুরবস্থায় করুণা করুন। আমি আপনাকে সস্তায় দেব। এর কত দাম হতে পারে? আপনার কী ধারণা?
মঁসিয়ে লেবলাঁ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জনদ্ৰেত্তে’র পানে তাকিয়ে বলল, ছবিটা একটা হোটেলের সামনে রাখা ছিল। এর দাম হবে তিন ফ্রাঁ।
জনদ্ৰেত্তে নরম গলায় শান্তভাবে বলল, আপনার কাছে টাকার ব্যাগটা আছে? আমি এটার জন্য চাই এক হাজার ক্রাউন।
মঁসিয়ে লেবলাঁ এবার সতর্ক হয়ে উঠে দাঁড়াল। ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখল জনদ্ৰেত্তে তার বাঁ দিকে আর তার স্ত্রী আর চারজন লোক দরজার কাছে তার ডানদিকে আছে। জনদ্ৰেত্তে তখন এমন সকরুণভাবে কথা বলে যাচ্ছিল যে মঁসিয়ে লেবলাঁ ভাবল এক দুর্ভাগ্যপীড়িত একজন মানুষ খুবই বিব্রত হয়ে পড়েছে; তার কথা ও কাজের মধ্যে কোনও মিল নেই।
জনদ্ৰেত্তে বলে যেতে লাগল, আপনি যদি ছবিটা না কেনেন তা হলে আমাকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ডুবে মরতে হবে। আমি আমার মেয়েদের প্যাকিং-এর ব্যবসা করতে বলেছিলাম। কিন্তু তার জন্য একটা টেবিল ও অনেক যন্ত্রপাতি কিনতে হবে। ঘরটা পরিষ্কার রাখতে হবে। অনেক খেটে চার ঘণ্টা কাজ করে মাত্র চার স্যু পাওয়া যাবে। তাতে কখনও চলে?
কথা বলার সময় মঁসিয়ে লেবলাঁর দিকে তাকাচ্ছিল না জনদ্ৰেত্তে। কিন্তু মঁসিয়ে লেবলাঁ’র দৃষ্টি তার ওপর বরাবর নিবদ্ধ ছিল। জনদ্ৰেত্তে শুধু বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছিল। মেরিয়াস তখন তাদের দু জনকেই দেখছিল। মঁসিয়ে লেবলাঁ শুধু তখন একটা কথাই ভাবছিল, লোকটা কি পাগল হয়ে গেছে! জনদেত্তে তখন একটা কথাই বারবার বলে যাচ্ছিল, নদীতে ডুবে মরা ছাড়া আমার আর কোনও উপায় নেই। একদিন আমি মরতে গিয়েছিলাম…
সহসা তার চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলে উঠল। তার চেহারাটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। সে মঁসিয়ে লেবলাঁর সামনে এসে বলল, ও সব কথা এখন থাক। আপনি আমাকে চিনতে পারছেন?
.
২০.
ঘরের দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল। বাইরে থেকে আরও তিনজন লোক এসে ঢুকল। তাদের পরনে ছিল কালো আলখাল্লা আর মুখে কাগজের মুখোশ। প্রথম লোকটার হাতে ছিল একটা ধারালো দা। দ্বিতীয় লোকটার হাতে ছিল একটা কুড়ুল আর তৃতীয় লোকটার হাতে ছিল একটা বড় চাবি।
জনদ্ৰেত্তে হয়তো এদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। সে লোকগুলোকে বলল, সব ঠিক আছে?
একটা রোগা মতো লোক বলল, হ্যাঁ, সব ঠিক আছে।
কিন্তু মঁতপার্নেসি কোথায়?
সে আপনার বড় মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে।
গাড়ি প্রস্তুত?
হ্যাঁ।
দুটো ভালো ঘোড়া?
হ্যাঁ, খুব ভালো।
জনদ্ৰেত্তে বলল, ঠিক আছে।
মঁসিয়ে লেবলাঁ’র মুখখানা ম্লান হয়ে গেল। ভীত হওয়ার থেকে সে বিস্মিত হল বেশি। সে শুধু লোকগুলোকে দেখতে লাগল। সামনে টেবিলটাকে সে একটা বাধা হিসেবে ব্যবহার করতে চাইল। ভয়ের কোনও চিহ্ন দেখা গেল না। যে কত ভালো ব্যবহার করছিল সে হঠাৎ একজন বলিষ্ঠ ব্যায়ামবিদের মতো ভয়ঙ্করভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠল। সে তার চেয়ারের পেছনটা শক্ত হাতে ধরে ছিল। বিপদের মুখে তার সাহস বেড়ে যেত। সদাশয়তার মতো তার সহিষ্ণুতাও ছিল অসাধারণ। তা দেখে তার প্রেমাস্পদের পিতা হিসেবে মঁসিয়ে লেবলাঁ’র জন্য গর্ববোধ করতে লাগল মেরিয়াস।
যে তিনজন লোক কারখানার ফার্নেসে কাজ করে বলে পরিচয় দিয়েছিল জনদ্ৰেত্তে, তারা ঘরের কোণে যেখানে কতকগুলি লোহার যন্ত্রপাতি ছিল সেখানে গিয়ে সেখান থেকে হাতুড়ি প্রভৃতি লোহার কতকগুলি অস্ত্র তুলে এনে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। বিছানায় যে বড় লোকটা ঘুমোচ্ছিল তার পাশে বসেছিল জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রী।
মেরিয়াস ভাবল এবার তার পিস্তল থেকে গুলি ছোঁড়ার সময় এসে গেছে। এবার পুলিশকে আসার জন্য সঙ্কেত জানাতে হবে। এদিকে জনদ্ৰেত্তে একটা লোকের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে মঁসিয়ে লেবলাঁর দিকে ফিরে এক নিষ্ঠুর হাসি হেসে বলল, আমাকে চিনতে পারছেন না?
না।