জনদ্ৰেত্তে বলল, হে উদারহৃদয় মহান, ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন। এই বলে সে তার স্ত্রীকে ইশারায় গাড়িভাড়া মেটাতে পাঠিয়ে দিল।
তার স্ত্রী চলে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল। ইতোমধ্যে জনদ্ৰেত্তে মঁসিয়ে লেবলাঁকে একটা চেয়ারে বসিয়ে টেবিলের ধারে অন্য একটা চেয়ারে বসল।
বরফের মতো ঠাণ্ডা রাত্রি। পথে-ঘাটে পড়া তুষারকণার উপর চাঁদের আলো পড়ে চকচক করছিল। রাস্তার আলোগুলো মিটমিট করে জ্বলছিল। তার মাঝে এলমগাছে ঘেরা বুলভার্দ অঞ্চলের নির্জন পথটা বিস্তৃত হয়ে ছিল। গর্বোর আশপাশে প্রায় এক মাইলের মধ্যে কোনও জনমানব ছিল না। জনদ্ৰেত্তে’র ঘরের মধ্যে তখন একটা বাতি জ্বলছিল। একই টেবিলের দুধারে দুটো চেয়ারে দু জন লোক বসেছিল। একজনকে প্রশান্ত আর একজনকে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল এবং একজন মহিলা ক্ষুধিত নেকড়ের মতো তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। আর এ ঘরে মেরিয়াস একা পিস্তল হাতে সেই টেবিলটার উপর দাঁড়িয়ে শ্বাসরুদ্ধভাবে এক দুর্ঘটনার অপেক্ষায় স্তব্ধ হয়ে ছিল।
মেরিয়াসের মনে তখন ভয়ের পরিবর্তে ছিল শুধু অপরিসীম ঘৃণা। পিস্তলের বাটে হাত দিয়ে সে নিজেকে আশ্বস্ত করে আপন মনে বলল, পশুটা কোনও অঘটন ঘটাতে চাইলে আমি তাকে থামাতে পারি। সে ভাবল, পুলিশ নিশ্চয় কোথাও আড়ালে লুকিয়ে আছে। পিস্তলের গুলির একটা আওয়াজ পেলেই ছুটে আসবে। তাছাড়া তার আশা হচ্ছিল মঁসিয়ে লেবলাঁ’র সঙ্গে জনদ্ৰেত্তে’র সংঘর্ষ বাধলে সে হয়তো অনেক রহস্যময় কথা জানতে পারবে। যে রহস্যের কথা সে এতদিন জানতে পারেনি, এই ঘটনা হয়তো তার ওপর আলোকপাত করবে।
.
১৯.
মঁসিয়ে লেবলাঁ এবার ঘরের দুটো শূন্য বিছানার দিকে তাকিয়ে বলল, আহত মেয়েটি কেমন আছে?
মুখে এক বিষণ কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটিয়ে জনদেত্তে বলল, ভালো। এখনও যন্ত্রণা হচ্ছে। তার দিদি তাকে হাসপাতালে ক্ষতটা খোবার জন্য নিয়ে গেছে। এখনি ফিরে আসবে।
মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, মাদাম ফাবান্ত সেরে উঠেছেন দেখছি।
সে দেখল জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রী দরজার কাছে পাহারা দেবার ভঙ্গিতে ভালো পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।
জনদ্ৰেত্তে বলল, সে এখনও দারুণ অসুস্থ। কিন্তু কী করা যাবে বলুন। তার মনের জোর খুব বেশি। সে যেন এক নারী নয় যেন একটা ষড়।
এ কথায় তার স্ত্রী অনুযোগের সুরে বলল, তুমি সব সময় আমার প্রশংসা কর মঁসিয়ে জনদ্ৰেত্তে।
মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, জনদ্ৰেত্তে? আমি তো জানতাম আপনার নাম ফাবান্ত।
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করল জনদ্ৰেত্তে, দুটোই আমার নাম। মঞ্চে যখন অভিনয় করতাম তখন আমার নাম ছিল জনদ্ৰেত্তে।
তার স্ত্রীর দিকে কড়াভাবে তাকাল জনদ্ৰেত্তে। মঁসিয়ে লেবলাঁ তা দেখতে পেল না।
জনদ্ৰেত্তে অন্য একটা বিষয়ের অবতারণা করে বলতে লাগল, আমরা স্বামী-স্ত্রী দু জনে কত সুখে জীবন যাপন করেছি একদিন। কিন্তু আমাদের ভাগ্য বড় খারাপ স্যার। আমাদের কাজ করার ইচ্ছা আছে, কাজ নেই। আমি জানি না দেশের সরকার কী করছে। জ্যাকবিনদের আমি কোনও ক্ষতি করতে না চাইলেও আমি নিজে কিন্তু গণতন্ত্রবাদীদের মতো জ্যাকবিন নই। আমি এখন বাধ্য হয়ে আমাদের মেয়েদের প্যাকিং-এর ব্যবসা শেখাতে চাই। আমাদের আগে যে অবস্থা ছিল তার তুলঁনায় এটা এক হীন ব্যবসা, কিন্তু যাই হোক, সভাবে জীবন যাপন করতে হবে। তো। আগেকার সৌভাগ্য আর সমৃদ্ধি তো আর নেই আমাদের। আমি ছবি আঁকার কাজ খুব ভালোবাসি। কিন্তু সে কাজ আমায় ছেড়ে দিতে হবে, কারণ খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে তো।
জনদ্ৰেত্তে যখন শান্তভাবে এইসব অসংলগ্ন কথাগুলো বলে চলেছিল মেরিয়াস তখন দেখল ঘরের মধ্যে এমন একজন এসে ঢুকল এর আগে সে ছিল না ঘরের মধ্যে। লোকটা এমন নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল যে দরজায় কোনও শব্দ হল না। তার গায়ে কোনও জামা ছিল না। গাঁয়ে ছিল শুধু একা ছেঁড়া ওয়েস্টকোট আর পায়ে দড়ি বাঁধা একজোড়া চটি। তার অনাবৃত হাতে উল্কি ছিল এবং তার মুখটা ছিল কালিমাখা। সে একটা বিছানায় জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রীর পেছনে বসল।
এক সহজাত প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে মঁসিয়ে লেবলাঁ সেদিকে তাকিয়ে লোকটাকে দেখে চমকে উঠল। জনদ্ৰেত্তে তা লক্ষ করল। সে বলল, আপনি বোধ হয় আপনার ওভারকোটটা দেখছেন। এটা আপনি ওবেলায় রেখে গিয়েছিলেন আমার জন্য। কোটটা সত্যিই চমৎকার। তাই নয় কি?
মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, ওই লোকটি কে?
জনদ্ৰেত্তে বলল, ও? ও হচ্ছে আমার প্রতিবেশী, ওর দিকে নজর দেবার দরকার নেই।
ব্যাপারটাকে সত্যিই সহজভাবে নিল মঁসিয়ে লেবলাঁ। কারণ ফবুর্গ সেন্ট মার্সো অঞ্চলে ওষুধের কারখানায় যেসব শ্রমিক কাজ করে তাদের মুখগুলো এমনি দেখায়।
নিজেকে সামলে নিয়ে মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, আপনি কী বলেছিলেন মঁসিয়ে ফাবান্ত?
জনদ্ৰেত্তে বলল, আমি বলেছিলাম, আমার একটা ছবি বিক্রি করার আছে।
দরজার কাছে একটা মৃদু শব্দ হল। আর একজন লোক বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে সেই বিছানায় বসল। প্রথম লোকটার মতো তার হাত দুটোও অনাবৃত ছিল এবং তার মুখেও কালি ছিল। সে নিঃশব্দে প্রবেশ করলেও মঁসিয়ে লেবলাঁ’র দৃষ্টি তার ওপর পড়ল।
জনদ্ৰেত্তে বলল, চিন্তার কোনও কারণ নেই। ওরা এই বাড়িতেই থাকে। আমার ছবিটা দামি। আপনি যদি অনুমতি দেন সেটা দেখাই আপনাকে।