ভাঙা চেয়ারটায় বসে পাইপ খেতে লাগল জনদ্ৰেত্তে। তার সঙ্গে তার স্ত্রী নিচু গলায় কথা বলছিল। পরিহাসরসিক কুরফেরাক এ দৃশ্য দেখলে জোর হেসে উঠত। রাজা দশম চার্লস-এর অভিষেকের সময় তাঁর প্রহরীরা যে কালো টুপি পরেছিল সেই ধরনের একটা কালো টুপি ছিল জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রীর মাথায়। তার গায়ে ছিল একটা পশমি স্কার্ট আর একটা শাল। তার পায়ে পুরুষদের একজোড়া জুতো যে জুতোর বিরুদ্ধে আজই সকালে তার মেয়ে অভিযোগ করে। তার এই বেশভূষা তার স্বামীর সমর্থন লাভ করেছে এবং তার মতে তার স্ত্রীকে এই বেশভূষায় সম্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে। জনদ্ৰেত্তে নিজে তখনও মঁসিয়ে লেবলাঁর দেওয়া সেই ওভারকোটটা পরে ছিল। তার ময়লা কাদা লাগা পায়জামাটার সঙ্গে কোটটার কোনও সংগতি ছিল না। তার পোশাকের এই গরমিলটাকেই কুরফেরাক কবিসুলভ এক বৈপরীত্য বলে অভিহিত করেছিল।
সহসা গলার স্বরটা উঁচু করে জনদ্ৰেত্তে বলে উঠল, একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ল আমার। এই সময় সে ঠিক এসে পড়বে। লণ্ঠনটা জ্বালিয়ে সদরদরজার কাছে গিয়ে অপেক্ষা করো। গাড়িটা কাছে এলেই দরজাটা খুলে দেবে। তার পর তাদের সিঁড়িতে আলো দেখিয়ে উপরে নিয়ে আসবে। এসেই আবার নিচে গিয়ে গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গাড়িটাকে ছেড়ে দেবে।
তার স্ত্রী বলল, কিন্তু টাকার কী হবে।
জনদ্ৰেত্তে তার পকেট থেকে পাঁচ ফ্রাঁ বার করে তার স্ত্রীর হাতে দিল।
তার স্ত্রী বলল, কোথায় পেলে টাকাটা?
জনদ্ৰেত্তে গম্ভীরভাবে উত্তর করল, আজ সকালে পাশের ঘরের ভদ্রলোকের কাছ থেকে। আর একটা কথা। আমাদের দুটো চেয়ার চাই।
তার স্ত্রী শান্ত কণ্ঠে বলল, পাশের ঘর থেকে নিয়ে আসব?
জনদ্ৰেত্তে বলল, বাতিটা নিয়ে যাও।
তার স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বলে গেল, বাতি চাই না। চাঁদের আলো আছে।
ভয়ের একটা হিমশীতল শিহরণ খেলে গেল মেরিয়াসের প্রতিটি রক্তশিরায়।
মেরিয়াস দেখল এখন টেবিল থেকে নেমে খাটের তলায় গিয়ে লুকোন কোনওমতেই সম্ভব নয়।
সে তাই শক্ত কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মেরিয়াস দেখল তার ঘরের দরজা ঠেলে একটা হাত অন্ধকারে হাতড়ে চেয়ারের খোঁজ করছে। জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রী ঘরের মধ্যে চারদিকে তাকালেও দেয়ালের কাছটায় অন্ধকার জমে থাকায় সে দেখতে পেল না মেরিয়াসকে।
চেয়ার দুটো নিয়ে বেরিয়ে গেল জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রী। সে বেরিয়ে যেতেই দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।
পাশের ঘরে গিয়ে স্ত্রী বলল, এই নাও চেয়ার।
তার স্বামী বলল, এই নাও লণ্ঠন। লণ্ঠন নিয়ে চলে যাও এখনি।
জনদ্ৰেত্তে চেয়ার দুটো টেবিলের দু ধারে রাখল। বাটালিটা আগুনে একবার পুড়িয়ে নিয়ে জ্বলন্ত কয়লাভরা কড়াইটার সামনে একটা পুরনো পর্দা টাঙিয়ে দিল, যাতে সেটা চোখে না পড়ে। এরপর দড়িটার উপর ঝুঁকে কী দেখল সে। দড়িটা জনদ্ৰেত্তে তুলঁতেই মেরিয়াস দেখল ওটা শুধু দড়ি নয়, দড়ির একটা মই। তাতে কাঠের আংটা আর দু’দিকে দুটো লোহার হুক লাগানো আছে। এই দড়ির মইটা বা টুকরো লোহার কোনও যন্ত্রপাতি আজ সকালে ঘরের মধ্যে ছিল না। মেরিয়াস বাইরে গেলে সে এগুলো কিনে আনে দোকান থেকে। এইসব যন্ত্রপাতি দিয়ে ঘরের দরজা ও তালা ভাঙা যায়। কোনও কিছু কাটার জন্য চোরেরা এইসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে।
কড়াই-এর কয়লার আগুনটা আর দেখতে না পাওয়ায় শুধু বাতির আলোয় আলোকিত হয়ে রইল ঘরটা। বিভিন্ন বস্তুর ছায়া জমে ছিল এখানে-সেখানে। ছায়াকালো এক ভয়ঙ্কর প্রশান্তি আর কুটিল নীরবতা বিরাজ করছিল ঘরখানায়।
জনদ্ৰেত্তে কী ভাবছিল। তার মুখের পাইপটা নিবে গিয়েছিল। বাতির স্বল্প মৃদু আলোয় তার মুখের কুটিল রেখাগুলো দেখা যাচ্ছিল না। তার ভ্রু দুটো ওঠানামা করছিল। তার হাত দুটো বারবার মুষ্টিবদ্ধ হচ্ছিল আর খুলে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সে নিজের অন্তরের সঙ্গে লড়াই করছিল। সেই নিঃশব্দ নিবিড় অন্তর্দ্বন্দ্ব আর স্বগতোক্তির মধ্যে হঠাৎ একসময় টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে তার ভেতর থেকে একটা ছুরি বার করে তার ধারটা পরীক্ষা করে আবার সেটা রেখে দিল জনদ্ৰেত্তে।
মেরিয়াস একটা পিস্তল বার করে তার ডান হাতে নিল। সেটা খুলে দেখল তার মধ্যে টোটা ভরা আছে কি না। বন্ধ করতে একটা শব্দ হতেই জনদ্ৰেত্তে চমকে উঠল। বলে উঠল, কে?
মেরিয়াস শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় স্তব্ধ হয়ে রইল।
তার পর নিজের মনেই জনদ্ৰেত্তে বলল, ও কিছু না, আমারই মনের ভুল। মেরিয়াস পিস্তলটা তার হাতে ধরে রাখল।
.
১৮.
দূরে সেন্ট মেদার্দ গির্জার ঘড়িতে ছটা বাজল। জানালার কাঁচগুলো যেন ঈষৎ কেঁপে উঠল। ছটা ঘণ্টাই গুনতে লাগল জনদ্ৰেত্তে। শেষ ঘণ্টাটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সে বাতিটা নিবিয়ে দিল। তার পর সারা ঘরময় পায়চারি করতে লাগল শান্তভাবে। সে আপন মনে বলতে লাগল, এখনও সে এল না।
এই বলে সে চেয়ারে বসতে যেতে না যেতেই ঘরের দরজাটা খুলে গেল।
জনদ্ৰেত্তে দেখল, তার স্ত্রী ঘরের সামনে বারান্দায় রয়েছে। সে কাকে বলল, দয়া করে ভেতরে আসুন মঁসিয়ে।
জনদেত্তে তাড়াতাড়ি উঠে বলল, হে মহান পরোপকারী, ঘরের ভেতরে আসুন।
ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল মঁসিয়ে লেবলাঁ। তার প্রশান্ত গাম্ভীর্য এক স্বতন্ত্র মহিমা দান করেছিল তার চেহারাটাকে। সে ঘরে ঢুকেই টেবিলের উপরে চারটে লুই রাখল। তার পর বলল, এইটা আপনার বাড়িভাড়া আর কেনাকাটার জন্য রাখুন। আর কী দরকার তা পরে দেখা যাবে।