মেয়েরা বলল, আমরা বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুত।
আমি যা যা বলেছি তোমরা তা যেন ভুলবে না। ঠিক ঠিক সব করবে তো?
কিছু ভাববে না।
জনদ্ৰেত্তে এবার একটা ভারী জিনিস তার হাত থেকে টেবিলের উপর নামিয়ে রাখল। যে বাটালিটা সে কামারশাল থেকে কিনে এনেছিল সেইটা বোধ হয়।
সে তার স্ত্রীকে বলল, খাবার কিছু আছে?
তার স্ত্রী বলল, হ্যাঁ, তিনটে বড় আলু ছিল, সিদ্ধ করে রেখেছি।
ভালো করছে। আগামীকাল আমি তোমাদের খুব ভালো করে অনেক কিছু খাওয়াব। কাল তোমরা রাজরাজড়াদের মতো খাবে।
এরপর গলার স্বরটা অনেক নামিয়ে সে ফিসফিস করে বলল, আগুনে ওটা ফেলে দাও। এবার এখন ফাঁদ তৈরি, বিড়ালরা অপেক্ষা করছে। ইঁদুর এসে ফাঁদে পড়লেই হল।
মেরিয়াস শুনতে পেল, কী একটা লোহার জিনিস কয়লার আগুনে ফেলে দেওয়া হল।
জনদ্ৰেত্তে বলল, দরজার কজায় তেল দিয়েছিলে যাতে শব্দ না হয়?
তার স্ত্রী বলল, হ্যাঁ।
এখন কটা বাজে?
ছ’টা বাজতে চলেছে। সেন্ট মেদার্দে সাড়ে পাঁচটার ঘণ্টা পড়ে গেছে।
জনদ্ৰেত্তে বলল, এবার মেয়েরা পাহারা দিতে চলে যাবে। শোন তোমরা, মাদাম বুগনল চলে গেছে?
তার স্ত্রী বলল, হ্যাঁ গেছে।
তোমরা জান পাশের ভদ্রলোক নেই?
উনি তো আজ সারাদিনই ছিলেন না। এখন আবার রাতের খাওয়ার সময়।
তোমরা ঠিক জান তো?
হ্যাঁ ঠিক।
ঠিক আছে। তবু একবার দেখে নেওয়ায় ক্ষতি কী?–এই নাও বাতিটা নিয়ে যাও।
মেরিয়াস সঙ্গে সঙ্গে টেবিল থেকে নেমে তার খাটের তলায় ঢুকে পড়ল গুঁড়ি মেরে। সে দেখল বড় মেয়েটি দরজা খুলে বাতি হাতে ঘুরে ঢুকল। সে ঘরের চারদিকে তাকিয়ে বিছানার দিকে সরে এল। মেরিয়াস ভয় পেয়ে গেল। আসলে সে আসছিল বিছানার উপর দেয়ালে টাঙানো একটা বড় আয়নায় মুখটা দেখতে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজের মুখটা দেখতে লাগল। এমন সময় পাশের ঘর থেকে দুটো ধাতুর মধ্যে ঠোকাঠুকির শব্দ কানে এল।
মেয়েটি এক হাতে চুলটা আঁচড়াতে আঁচড়াতে মোটা গলায় গান গাইতে লাগল। গানের বাণীটি ছিল এই রকম : আমাদের প্রেম খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেছে। আমাদের সুখও সব এখন বিগত। মাত্র একটা সপ্তার জন্য পেয়েছিলাম আমার প্রেমিককে। কিন্তু প্রকৃত প্রেম চিরকালের। তা বেঁচে থাকে চিরকাল।
মেরিয়াস খাটের তলায় কাঁপতে লাগল ভয়ে। তার নিশ্বাসের শব্দ হয়তো শুনতে পাচ্ছে মেয়েটা।
মেয়েটা এবার জানালার ধারে গিয়ে আপন মনে বলল, মনে হচ্ছে সমস্ত প্যারিস শহরটা যেন একটা সাদা জামা পরেছে।
আবার সে আয়নার সামনে ফিরে এসে দাঁড়াল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল নিজেকে। তার বাবা হেঁকে বলল, কী করছিলি?
মেয়েটি বলল, আমি ঘরটার সব জায়গা খুঁজে দেখছি। ঘরে কেউ নেই।
এই বলে সে তার মাথার চুলটা ঠিক করতে লাগল।
তা হলে চলে এস। নষ্ট করার মতো সময় নেই।
ঠিক আছে, আমি আসছি।
সে আবার গানটা গাইতে লাগল। তুমি আমাকে ফেলে তোমার গৌরবের পথে চলে গেছ। কিন্তু আমার অন্তর তুমি যেখানেই যাবে অনুসরণ করবে তোমাকে ছায়ার মতন।
এরপর শেষবারের মতো একবার আয়নার দিকে তাকিয়ে দরজাটা বন্ধ করে চলে গেল মেয়েটি। মেরিয়াস শুনতে পেল দুই বারান্দা পার হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। তাদের বাবার গলা শোনা গেল, মনে রাখবে একজন থাকবে ব্যাঙ্কিয়েরের দিকে, আর একজন থাকবে ব্যারিয়েরের দিকে। বাড়ির সদরদজার ওপর থেকে চোখ সরাবে না কখনও। কোনও কিছু দেখলে দু জনে এসে খবর দেবে আমাকে।
বড় মেয়েটি বলল, খালি পায়ে বরফের উপর দাঁড়িয়ে পাহারা দেওয়া খুব ভালো কাজ।
জনদ্ৰেত্তে বলল, কাল তোমরা খুব ভালো জুতো পাবে।
এবার তারা দু জনেই বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
মেরিয়াস দেখল, এখন গোটা বাড়িটার মধ্যে জনদ্ৰেত্তে, তার স্ত্রীর আর সেই অচেনা লোকগুলো ছাড়া আর কেউ নেই।
.
১৭.
সময় বুঝে মেরিয়াস আবার টেবিলের উপর উঠে গিয়ে ফুটোটার মধ্য দিয়ে দেখতে লাগল। ঘরখানার মধ্যে একটা পরিবর্তন হয়েছে। এখন একটা বাতি জ্বলছে। সেই বাতির আলোয় মেরিয়াস দেখল জ্বলন্ত চুল্লির উপর একটা লোহার কড়াই-এর উপর একরাশ জ্বলন্ত কয়লা চাপানো আছে। কড়াইটাও গরমে লাল হয়ে উঠেছে। জ্বলন্ত কয়লাগুলোর উপর আগুনের একটা নীলচে শিখা দেখা যাচ্ছিল। কম্পিত শিখাটাকে দেখে মনে হচ্ছিল সেটা যেন নাচছে। সেই আগুনের আভায় দেখা গেল কাছেই জনদ্ৰেত্তে’র কিনে আনা সেই বাটালিটা পড়ে আছে। ঘরটার এককোণে একগাদা লোহার টুকরো আর বেশ কিছু দড়ি পড়ে আছে। বাইরে থেকে ওদের ঘরটাকে যেন নরকের দ্বারের পরিবর্তে কামারশালের মতো মনে হচ্ছিল। জনদ্ৰেত্তে তেমনি একজন কামারের বদলে একটা দানব বলে মনে হচ্ছিল।
তপ্ত কড়াই-এর আগুনটার এত জোর ছিল যে তার আঁচে অদূরবর্তী বাতির মোমগুলো গলে গলে পড়ছিল চুল্লির আগুনে। ধোয়াটা অবশ্য চিমনি দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। জানালাগুলোর কাঁচের সার্সির দিয়ে চাঁদের আলোর ছটা দেখে মেরিয়াসের কবি-মনে এই ভাব জাগল যে, স্বর্গ থেকে যেন এক আলোর ছটা এসে মর্ত্যের এক কুৎসিত পরিবেশের সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে গেছে। জনদ্ৰেত্তে’র ঘরটা যে কোনও অপরাধমূলক কাজকর্মের পক্ষে খুবই প্রশস্ত ছিল। প্রথমত বাড়িটা ছিল প্যারিসের শহরতলির এক নির্জন পরিবেশে। বাড়িটা বুলভার্দে অবস্থিত হলেও তার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না। বাড়িটার এক দিকে বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ দেখা যায়। তাছাড়া বাড়িটাও নির্জন এবং পরিত্যক্তপ্রায়। দুটো ছাড়া সব ঘরই খালি।