ওর চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ও কারও অনুসরণ করছে।
দেখে তা তো মনে হচ্ছে না। কিন্তু কাকে ও অনুসরণ করছে?
হয়তো কোনও মেয়েকে দেখে ওর ভালো লেগেছে।
কিন্তু কোনও মেয়েকে তো কোথাও দেখছি না।
কুরফেরাক মেরিয়াসের দিকে তাকিয়ে বলল, ও একটা লোককে অনুসরণ করছে।
ওরা দেখল যে লোকটাকে অনুসরণ করছিল মেরিয়াস সে মাথায় টুপি পরে মেরিয়াসের আগে আগে তার মাত্র কুড়ি পা দূরে যাচ্ছিল। ওরা শুধু লোকটার পেছনটা দেখতে পাচ্ছিল। তবে ওরা বেশ বুঝতে পারছিল লোকটার মুখে দাড়ি আছে। লোকটা একটা নতুন ওভারকোট আর একটা ছেঁড়াখোঁড়া কাদা-লাগা পায়জামা পরেছিল।
বোসেত হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে বলল, লোকটা কে?
কুরফেরাক বলল, নিশ্চয় কোনও কবি। একমাত্র কবিরাই ভবঘুরের মতো ছেঁড়া ময়লা পায়জামা আর লর্ডদের মতো ওভারকোট পরে।
বোসত বলল, চল, ওদের পিছু নেওয়া যাক।
কুরফেরাক বলল, কী বোসেত, তুমি কি পাগল হয়েছ? একটা লোক একটা লোককে অনুসরণ করছে, তুমি আবার তার অনুসরণ করতে চাও?
ওরা দু জনে অন্য পথ ধরে চলে গেল।
মেরিয়াস জনদ্ৰেত্তেকে মুফেতার্দে দেখতে পায়। সে কোথায় যায় বা কী করে তা দেখার। জন্য সে তার পিছু নিল। তার কেউ পিছু নিয়েছে একথা মোটেই বুঝতে পারেনি জনদ্ৰেত্তে। সে নিশ্চিন্ত মনে হেঁটে যাচ্ছিল। সে প্রথমে র্যু গ্রেসিউজে গিয়ে একটা বাড়িতে মিনিট পনেরো কাটাল। তার পর সে র্যু মুফেতার্দের একটা কামারশাল হতে কাঠের বাটওয়ালা একটা লোহার বাটালি নিয়ে বেরিয়ে এল। তার পর র্যু দ্য পেতিত ব্যাঙ্কিয়েরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। মেরিয়াস দেখল রাস্তাটা ফাঁকা এবং এমত অবস্থায় তাকে অনুসরণ করা ঠিক হবে না। মেরিয়াস দূর থেকে তাকে লক্ষ করতে লাগল। দেখল, জনদ্ৰেত্তে রাস্তার ধারের সেই পাঁচিলটা পার হয়ে সেই পতিত জায়গাটায় চলে গেল।
মেরিয়াস ঠিক করল জনদ্ৰেত্তে বাসায় ফেরার আগেই সে ফিরে যাবে। সেইটাই ঠিক হবে। তাছাড়া মাদাম বুগনল কাজ করতে বেরিয়ে গেল সদরদরজায় চাবি দিয়ে যাবে। তার কাছে যে বাড়তি চাবি ছিল তা সেই ইন্সপেক্টরকে দিয়ে দিয়েছে।
তখন অন্ধকার হয়ে আসছিল। আকাশে চাঁদ উঠছিল ধীরে ধীরে। সালপেত্রিয়ের চারদিকে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ছিল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পা চালিয়ে বাসার দিকে ফিরে যেতে লাগল মেরিয়াস। পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে উঠে বারান্দার দেয়ালে পিঠ দিয়ে নিঃশব্দে তার ঘরটায় চলে গেল। সদরদরজাটা তখনও খোলা ছিল বলে বাড়িটাতে সহজেই ঢুকতে পারল। বারান্দার ধারের ঘরগুলোয় তখন কোনও ভাড়াটে ছিল না বলে মাদাম বুগনল খুলে রাখত। মেরিয়াস একটা ভোলা ঘরে চকিতে দৃষ্টি ফেলে দেখল চারজন লোক স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তাদের মাথাগুলো অল্প অল্প দেখা যাচ্ছিল। সে এর থেকে বেশি আর কিছু দেখতে চাইল না। তাকেও কেউ দেখতে পেল না। এইভাবে অদৃশ্য অবস্থায় সে তার ঘরে গিয়ে ঢুকল। ঠিক সময়েই এসে পড়েছে সে। কারণ সে ঢোকার পরমুহূর্তেই মাদাম বুগনল সদরদরজায় চাবি দিয়ে বেরিয়ে গেল।
.
১৬.
মেরিয়াস বিছানার উপর বসে পড়ল। তখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। আর মাত্র আধ ঘণ্টা সময় আছে। তার দেহের শিরায় শিরায় রক্তচলাচলের গতিবেগ এত বেড়ে গিয়েছিল যে সে যেন তার রক্তস্রোতের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল সন্ধ্যার ঘনায়মান ছায়ান্ধকারে অপরাধীরা যেন সমবেত হচ্ছে। অন্য দিকে অন্যায়ের হাতে ন্যায়ের নির্জিত হবার সময় এগিয়ে আসছে। সে ঠিক ভয় পায়নি। তবে একটু পরে কী ঘটবে তা ভাবতে গিয়ে বুকটা কেঁপে উঠছিল তার। আজ সারাদিন ধরে যা যা ঘটে গেছে তা সব একটা দুঃস্বপ্নের কতকগুলি অস্পষ্ট ছায়াদৃশ্য বলে মনে হচ্ছিল। শুধু তার কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তল দুটোয় হাত পড়তেই বাস্তবসচেতন হয়ে উঠল সে।
তখন তুষারপাত একরকম বন্ধ হয়ে গেছে। কুয়াশা ভেদ করে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। চারদিকে পড়ে থাকা সাদা তুষারের উপর চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে যে এক শুভ্র-উজ্জ্বল আভার দৃষ্টি হয় সেই আভার একটা অংশ মেরিয়াসের ঘরে এসে পড়েছিল। জনদ্ৰেত্তে’র ঘরে একটা আলো জ্বলছিল। মেরিয়াস দেয়ালের উপর দিকের সেই ফুটোটা দিয়ে দেখল নিস্তব্ধ ঘরখানার মধ্যে রক্তচক্ষুর মতো লাল আগুনের একটা ক্ষীণ শিখা দেখা যাচ্ছিল। এটা কোনও বাতির আলো নয়। এক জ্বলন্ত আগুন। ঘরখানা এতদূর নিস্তব্ধ যে আগুনটা না থাকলে সেটাকে আস্ত সমাধিগহ্বর বলে মনে হত।
পায়ের জুতো খুলে টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে ছিল মেরিয়াস। এমন সময় সদরদরজাটা খোলার শব্দ হল এবং তার পর জনদ্ৰেত্তে তার ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। ঠিক সেই সময় বারান্দার ধারে একটা ঘরে যে চারজন লোককে অন্ধকারে সন্দেহজনকভাবে অপেক্ষা করতে দেখেছিল মেরিয়াস, তারা এসে দেখা করল জনদ্ৰেত্তের সঙ্গে। নেকড়ের বাচ্চাগুলো যেন নেকড়েমাতা আসার সঙ্গে সঙ্গে সজাগ ও সচেতন হয়ে উঠেছে।
ঘরে ঢুকেই জনদ্ৰেত্তে বলল, আমি এসে গেছি।
মেয়েরা বলল, শুভসন্ধ্যা বাবা।
তার স্ত্রী বলল, এস।
জনদ্ৰেত্তে বলল, সব ভালোভাবেই হয়ে গেছে। কিন্তু আমার পা দুটো শীতে জমে গেছে। আমি দেখছি তোমরা পোশাক পরেছ। ভালো।