নিজের মনে মেরিয়াস বলল, এই বদমাশ দুবৃত্তগুলোকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে।
কিন্তু তাদের যে সব কথা সে শুনতে পেয়েছে সে কথায় কোনও রহস্য উদঘাটিত হয়নি। তাতে শুধু রহস্যটা ঘোরালো হয়েছে আরও। সে লুক্সেমবুর্গের বাগানে দেখা সেই মেয়েটি আর তার পিতার সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারেনি। শুধু এইটুকু জেনেছে যে জনদ্ৰেত্তে তাদের চেনে। তাদের কথাবার্তা থেকে আর একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার কাছে। সেটা হচ্ছে এই যে মঁসিয়ে লেবলাঁদের জন্য একটা ফাঁদ পাতা হচ্ছে। এটা সত্যিই ভয়ের কারণ। জনদ্ৰেত্তের সব কৌশল ব্যর্থ করে দিয়ে মাকড়সার জালের মতো এই চক্রান্তজাল ছিন্নভিন্ন করে দিতে হবে।
সে দেখল জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রী ঘরের কাজ করছে। সে খুব সাবধানে কোনও শব্দ না করে টেবিল থেকে নেমে পড়ল। জনদ্ৰেত্তে যে ফাঁদ পেতেছে তার জন্য তার মনে ভয় হলেও সেই সঙ্গে একটা খুশির আলোও উঁকি মারছিল সেই ভয়ের অন্ধকারে। সে তার প্রিয়তমার জন্য কিছু করবে, তাদের কোনও উপকারে লাগবে এই ভেবে আনন্দ জাগছিল তার মধ্যে।
কিন্তু কেমন করে তা সম্ভব? সে তো তাদের বাসার ঠিকানা জানে না যে আগে থেকে সতর্ক করে দেবে তাদের। তারা এখানে এসেই কিছুক্ষণের মধ্যে চলে গেছে। অবশ্য ছটার সময় পথে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের সাবধান করে দিতে পারে। কিন্তু জনদেত্তে আর তার দলের লোকরা নিশ্চয় বাড়ির বাইরে পথে আগে হতেই দাঁড়িয়ে থাকবে। তখন রাস্তা ফাঁকা থাকবে এবং তাতে তাকে দেখে চিনতে পারবে। তা হলে তারা হয়তো তাকে তাড়িয়ে দেবে সেখান থেকে অথবা তুলে নিয়ে যাবে।
তখন বেলা একটা বাজে। আর পাঁচ ঘণ্টা সময় হাতে আছে। তার মধ্যে কিছু না কিছু করতে হবে। একটা মাত্র উপায় আছে। সে তার ভালো পোশাকটা পরে মাথায় টুপি চাপিয়ে আর গলায় চাদর জড়িয়ে বাড়ি থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ল।
সে বুলভার্দ অঞ্চলটা তাড়াতাড়ি পার হয়ে পেতিত ব্যাঙ্কিয়েরের কাছে চলে গেল। এ রাস্তাটা নিচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল দু ধারে। পাঁচিলটা ডিঙিয়ে পার হওয়া যায়। পাঁচিলটার ওধারে কিছু পতিত জমি আছে। মেরিয়াস পাঁচিলটার ধার দিয়ে যাচ্ছিল। সহসা কয়েকজন মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে। তখন বরফ পড়ছিল। বরফ পড়ার ফলে পথ চলতে কষ্ট হচ্ছিল তার। তার ওপর চিন্তায় মাথাটা ভারী হয়ে ছিল তার; মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেও সে চারদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। উজ্জ্বল। দিনের আলোয় সে কাউকে দেখতে না পেয়ে সে পথের ধারের পাঁচিলের ওপাশটা একবার দেখল।
দেখল দু জন লোক ওধারে পাঁচিলটার গায়ে ঠেস দিয়ে বসে কথা বলছে। তাদের কাউকে চেনে না সে। তাদের মধ্যে একজনের মুখে দাড়ি আর মাথায় টুপি ছিল এবং তার পরনে ছিল একটা আলখাল্লা। অন্যজনের পোশাকটা ছিল ছেঁড়াখোঁড়া আর তার একমাথা লম্বা লম্বা চুল ছিল। তার মাথায় টুপি ছিল না বলে তার মাথার চুলে বরফের কণাগুলো চকচক করছিল। পাঁচিলের উপর ঝুঁকে তাদের কথা শুনতে লাগল মেরিয়াস।
লম্বা চুলওয়ালা লোকটা বলল, পেত্ৰন মিনেত্তে যখন একসঙ্গে আছে তখন তা কিছুতেই ব্যর্থ হবে না।
দাড়িওয়ালা লোকটা বলল, তুমি তাই মনে কর?
হ্যাঁ, নিশ্চয়, পাঁচশো ফ্ৰাঁ করে প্রত্যেকেই পাবে। আর তাতে খারাপ কিছু যদি হয় তো পাঁচ বছরের জেল।
মাথায় গ্রিক টুপি পরা লোকটা টুপির নিচে মাথাটা চুলকে বলল, এ টাকা হাতছাড়া করা উচিত হবে না।
চুলওয়ালা লোকটা বলল, কাজটা ঠিক হবে। তবে মাস্টার হোয়াটসিটকে ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হবে।
ওরা গতকাল থিয়েটারে দেখা এক নাটক নিয়ে কথা বলতে শুরু করলে মেরিয়াস চলে গেল সেখান থেকে।
মেরিয়াসের মনে হল যে কথাগুলো সে তাদের মুখ থেকে শুনল, জনদেত্তের চক্রান্তের সঙ্গে তার নিশ্চয় একটা সম্পর্ক আছে। লোক দুটো তুষারপাতের মধ্যে
সন্দেহজনকভাবে বসে এ বিষয়েই নিশ্চয় আলোচনা করছিল।
মেরিয়াস ফবুর্গ সেন্ট মার্সের পথে এগিয়ে গিয়ে প্রথমেই যে দোকানটা পেল সেখানে সে জিজ্ঞাসা করল, এ অঞ্চলে সবচেয়ে কাছে যে থানা আছে তার ঠিকানাটা কী?
দোকানদার বলল, তার ঠিকানা হচ্ছে ১৪ নম্বর র্যু দা পঁয়য়।
থানার দিকে যেতে যেতে মেরিয়াস ভাবল আজ রাতে তার খাওয়া হবে না। তাই সে একটা রুটির দোকান থেকে একটা পাউরুটি নিয়ে সেটা খেয়ে আবার পথ চলতে লাগল।
সে আরও ভাবল; ভাগ্যের বিধান ফলবেই। সে যদি জনদ্ৰেত্তে’র বড় মেয়েকে পাঁচ ফ্রাঁ না দিত এবং সেটা যদি তার কাছে থাকত তা হলে গাড়িভাড়া করে মঁসিয়ে লেবলাঁকে অনুসরণ করত তার ঠিকানা দেখার জন্য। তা হলে সে জনদ্ৰেত্তে’র চক্রান্তের কথা কিছুই। জানতে পারত না। তা হলে মঁসিয়ে লেবলাঁ আর তার মেয়ে চরম বিপদের সম্মুখীন হত।
.
১৪.
থানায় পৌঁছে মেরিয়াস একতলায় অফিসে গিয়ে পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে চাইল।
একজন কেরানি বলল, তিনি এখন নেই। একজন ইনসপেকটর কাজ করছেন তাঁর জায়গায়। আপনার কি বিশেষ দরকার আছে?
হ্যাঁ।
কেরানি তাকে একটা ঘর দেখিয়ে দিল। মেরিয়াস সেই ঘরে গিয়ে দেখল, একজন লম্বা লোক একটা বড় কোট পরে দাঁড়িয়েছিল একটা বড় স্টোভের ধারে। তার মুখটা চওড়া, পাতলা ঠোঁট, ধূসর রঙের ঘন গালপাট্টা ছিল দু গালে। তার চোখের দৃষ্টি ছিল তীক্ষ্ণ আর সন্ধানী। তবে জনদ্ৰেত্তে’র থেকে তাকে কম হিংস্র আর ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল।