আমি বলছি সে-ই। পরে দেখবে তুমি।
জনদ্ৰেত্তে’র এই দৃঢ় আশ্বাসে তার স্ত্রী আরও হতবুদ্ধি হয়ে উঠল। সে বিহ্বলভাবে ছাদের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চওড়া মুখখানা বিকৃত হয়ে উঠল। মেরিয়াসের মনে হল সে তার স্বামীর থেকে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। একটা শূকরী যেন বাঘিনীর মূর্তি ধারণ করেছে।
সে বলতে লাগল, সেই মেয়েটা। এক সম্ভ্রান্ত মহিলার মতো পোশাক পরে এসে আমার মেয়েদের সঙ্গে করুণার সঙ্গে কথা বলছে। আমার মনে হচ্ছে ওর পেটের উপর পা দিয়ে দাঁড়াই।
বিছানা থেকে উঠে সে স্তব্ধভাবে বসে রইল। মাথার চুলগুলো আলুথালু হয়ে উঠেছে তার, নাসারন্ধ্র দুটি কাঁপছে। মুখটা অর্ধবিস্ফারিত। তার হাত দুটো ঘুষি পাকিয়ে উঠল। এই অবস্থায় সে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল।
কিন্তু তার স্বামী তার এই অবস্থার দিকে না তাকিয়ে ঘরটার মধ্যে আবার নীরবে পায়চারি করতে শুরু করে দিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে তার স্ত্রীর কাছে গিয়ে বলল, আর একটা কথা শুনবে?
কী কথা?
সে নিচু গলায় বলল, এতে আমাদের সৌভাগ্য বৃদ্ধি হবে।
তার স্ত্রী তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যাতে মনে হল সে ভাবছে তার স্বামীর বোধশক্তিরহিত হয়ে পড়েছে।
তার স্বামী বলে যেতে লাগল, আমি অনেক বাজে কাজে ঘুরে বেড়িয়েছি। ক্ষুধায় খাদ্য চেয়ে উপবাস এবং অনশন পেয়েছি। শীতের তাপ চেয়ে শীতে জমে গিয়েছি। এইভাবে পথের কুকুরের মতো ঘুরে বেড়ানো আর আমার ভালো লাগে না। ঈশ্বরের এক নিষ্ঠুর পরিহাস আর আমি পছন্দ করি না। আমি এখন যথেষ্ট খাদ্য ও পানীয় চাই। নিশ্চিন্তে ঘুমোতে চাই। আমি চাই অনায়াসলব্ধ সচ্ছলতা। এবার আমার পালা। মরার আগে আমিও লক্ষপতির মতো জীবনকে উপভোগ করতে চাই।
সে আবার পায়চারি করতে করতে বলল, আমি এবং আরও কয়েকজন।
তার স্ত্রী বলল, কী বলতে চাইছ তুমি?
কী বলতে চাইছি? বলছি, কী বলতে চাইছি—
তার স্ত্রী বলল, চুপ কর। আস্তে বল। তেমন কিছু হলে বাইরের কেউ যেন না শোনে। বাইরের কে? পাশের ঘরের লোকটা? আমি কিছুক্ষণ আগে তাকে বেরিয়ে যেতে দেখেছি। কাজেই সে শুনছে এই ভেবো না। আমি বলছি আমি তাকে বেরিয়ে যেতে দেখেছি।
জনদ্ৰেত্তে গলার স্বরটা নিচু করলেও তার কথা শুনতে অসুবিধা হচ্ছিল না মেরিয়াসের। তবে তার সব কথা শুনতে পাওয়ার আর একটা কারণ হল তুষারপাত। বাইরে তুষারপাতের জন্য রাস্তার যানবাহনের কোনও শব্দ আসছিল না ঘরে।
জনদ্ৰেত্তে বলতে লাগল, শোন। ওই পরোপকারী ভদ্রলোককে আমি পেয়ে গেছি। সে আমার থলের ভেতর ভরা আছে ধরে নিতে পার। আমি কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। সে ছটার সময় আসছে ষাট ফ্রাঁ নিয়ে। সব ঠিক হয়ে আছে। আমি তাকে বাড়ি ভাড়ার কথা কেমন বানিয়ে বলেছি। সে ছটার সময় যখন আসবে, পাশের ঘরের প্রতিবেশী তখন বাইরে খেতে যাবে হোটেলে এবং এগারোটার আগে আসবে না। বুড়ি বুগনল ঘর পরিষ্কারের কাজে যাবে। এখানে জনপ্রাণীও থাকবে না। মেয়েরা বাইরে পাহারা দেবে। তুমি সাহায্য করবে। সুতরাং সে ফাঁদে পড়বেই।
কিন্তু মনে কর–সে যদি না আসে।
জনদ্ৰেত্তে বলল, আমরা জানি তখন কী করতে হবে।
মেরিয়াস আজ প্রথম হাসতে দেখল জনদ্ৰেত্তেকে। তার নিষ্ঠুর হিমশীতল হাসির শব্দে বুকটা কেঁপে উঠল তার। জনদ্ৰেত্তে আলমারি খুলে একটা টুপি বার করে পরল মাথায়। তার পর সে বলল, আমাকে এখন বাইরে যেতে হবে। আরও লোক আছে, তাদের সঙ্গে। কথা বলতে হবে। এ এক বড় খেলা। আমি শিগগির ফিরে আসব। তুমি বাড়িতে থাক।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কী ভেবে নিয়ে জনদ্ৰেত্তে আবার বলল, সে আমাকে চিনতে পারেনি এটা ভাগ্যের কথা। সে আমায় চিনতে পারলে আর আসত না। আমার এই দাড়িটাই আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছে।
সে আবার হাসতে লাগল। সে জানালার ধারে গিয়ে দেখল বাইরে বরফ পড়ছে।
তা দেখে বলল, কী বাজে আবহাওয়া।
এই বলে গরম কোটটা পরল। বলল, কোটটা বড় হচ্ছে। লোকটা কোটটা রেখে যাওয়ায় খুব ভালো হয়েছে। তা না হলে বেরোতে পারতাম না। তা হলে সব সুযোগ হারাতে হত। এক একসময় ঘটনার যোগাযোগটা ভালোই হয়।
টুপিটা মুখের সামনের দিকে ঠেলে বেরিয়ে পড়ল জনদ্ৰেত্তে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে দরজা ঠেলে আবার সে ঘরে ঢুকল। সে বলল, একটা কথা বলছি। তোমার কয়লার আগুনটা জ্বেলে রাখতে হবে।
মঁসিয়ে লেবলাঁ’র দেওয়া পাঁচ ফ্রাঁ পকেট থেকে বার করে জনদ্ৰেত্তে তার স্ত্রীর হাতে দিল।
তার স্ত্রী বলল, কয়লার আগুন?
হ্যাঁ।
কত কয়লা চাই।
দু কিলো মতো।
তা হলে তিরিশ স্যু লাগবে। বাকি পয়সাতে আমি রাতের খাবার ব্যবস্থা করব।
মোটেই না।
কেন নয়?
এর থেকে আর কোনও খরচ করলে চলবে না। আমাকে একটা জিনিস কিনতে হবে।
কী জিনিস?
কিছু একটা–এখানে কোনও কামারশাল আছে?
র্যু মুফেতার্দে আছে।
হ্যাঁ, জায়গাটা আমি জানি।
তোমার জিনিসটার দাম কত হবে?
দু-তিন ফ্রাঁ।
তা হলে তো রাতের খাওয়া তাতে হবে না।
হয় না-খেয়ে থাকতে হবে। কারণ এর থেকে দরকারি একটা কিছুর কথা ভাবতে হচ্ছে আমায়।
ঠিক আছে প্রিয়তম।
দরজাটা পেছন থেকে বন্ধ করে এবার চলে গেলে জনদ্ৰেত্তে। মেরিয়াস সিঁড়িতে তার দ্রুত পদশব্দ শুনতে পেল।
সেন্ট মেদার্দ গির্জার ঘড়িতে বেলা একটা বাজল।
.
১৩.
দিবাস্বপ্নে প্রায়ই মত্ত হয়ে থাকলেও মেরিয়াস সময়মতো দৃঢ়তার সঙ্গে কোনও কাজে নেমে পড়তে পারত। সে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করার ফলে অলস হয়ে ওঠে এবং করুণা ও সহানুভূতি এই গুণ দুটি তার মধ্যে গড়ে ওঠে। পরোপকার প্রবৃত্তির সঙ্গে তার মধ্যে বিচারকের এক কঠোরতা ছিল। সে যেমন এক ব্যাঙের উপর দয়া দেখাত, তেমনি বিষাক্ত সাপকে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিতে পারত। সে যে ঘরের দিকে ফুটো দিয়ে তাকিয়ে ছিল সেটা সত্যিই এক বিষাক্ত সাপের গর্ত, রাক্ষসদের গুহা। সেখানে যেন কোনও মানুষ থাকে না।